কোনো ব্যবসায়ী যখন কোনো ব্যবসা বা উদ্যোগ নিয়ে কাজ করেন তখন তার মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত দুটো। প্রথমত, ভোক্তার অধিকার রক্ষা করা এবং তাকে সেবা দিয়ে সন্তুষ্ট করা। আর দ্বিতীয়টি হলো, গ্রাহককে সন্তুষ্ট করার মাধ্যমে অল্প ব্যয়ে অধিক মুনাফা আয় করা। যখনই কোনো ব্যবসায়ী এই দুটি বিষয়ের অন্তত একটিকেও বাদ দিয়ে ব্যবসার পরিকল্পনা করেন তখনই তার কাজের ফল খারাপের দিকে অগ্রসর হয়। সেই ব্যবসায় লাভ না হয়ে ক্ষতি হতে শুরু করে এবং কিছু ক্ষেত্রে সেই ব্যবসা বন্ধ হয়ে যেতেও পারে।
“ইভ্যালি” নামটির সাথে আমরা এতদিনে বেশ পরিচিত হয়ে গেছি। নিশ্চয়ই জেনে থাকবেন এটিও একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, যারা অনলাইনের মাধ্যমে অর্ডার নিয়ে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পণ্য পৌঁছে দিতো গ্রাহকের কাছে। ইভ্যালির সিইও মোহাম্মদ রাসেল এবং তার স্ত্রী হলেন একই প্ল্যাটফর্মের চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন।
চলুন এই অনলাইন মার্কেটপ্লেস ইভ্যালির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক-
- কোম্পানী গ্রাহকদের প্রলুব্ধ করতে এর ওয়েবসাইটে বিশাল ডিসকাউন্ট এবং ৭-৪৫ দিনের মধ্যে ডেলিভারির প্রতিশ্রুতি দেয়। তারা অগ্রিম অর্থও গ্রহণ করে। দাবীকৃত ডেলিভারির সময় অতিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও, অনেক ভোক্তা তাদের অর্ডার করা জিনিসগুলি এখনও পাননি।
ইভ্যালি সরবরাহ করতে ব্যর্থ হওয়ার পরে গ্রাহকদের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে প্রতিদানের চেক দেয়া হয়েছিল, কিন্তু ইভ্যালির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অপর্যাপ্ত অর্থ থাকার কারণে বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে চেকগুলি বাউন্স হয়ে যায়৷
- আরিফ বাকের নামে এক গ্রাহক অগ্রিম অর্থ প্রদানের পরেও ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মটি পণ্য সরবরাহ না করার অভিযোগে গুলশান থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। পরবর্তীতে ইভ্যালির সিইও ও চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ ও চেক জালিয়াতির একাধিক অভিযোগ দায়ের করা হয়। গত ১৬ সেপ্টেম্বর ওই দম্পতিকে গ্রেপ্তার করা হয়। এদিকে গ্রাহক ফরহাদ হোসেন বিপাকে থাকা কোম্পানিটি ভেঙে দিয়ে নতুন করে কোম্পানির পরিচালনা পরিষদ গঠনের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেন।
- ২২ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট আবেদনের ওপর শুনানির সময় স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি ও হস্তান্তরের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে এবং ইভ্যালিকে কেন ভেঙে দেওয়া উচিত নয় তা নিয়ে একটি নোটিশ জারি করে।
- সেপ্টেম্বরেই এই বিষয়ে একটি শুনানির সময় হাইকোর্ট রেজিস্ট্রার অফ জয়েন্ট স্টক কোম্পানি অ্যান্ড ফার্ম(RJSC)-কে নির্দেশ দেয় ইভ্যালির সমস্ত নথি ১১ই অক্টোবরের মধ্যে জমা দিতে, যা তারা দিয়েছে।
- এরপর বোর্ড কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। গত ১৩ই অক্টোবর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বোর্ড গঠনের জন্য তিন সাবেক সচিবের নাম হাইকোর্টে পাঠায়।
- ইভ্যালির নিজস্ব হিসাব অনুযায়ী এর সম্পদ ১২১ কোটি টাকা। কিন্তু এটির ভোক্তা এবং ব্যবসায়ীদের কাছে ১,০০০ কোটি টাকারও বেশী দায় রয়েছে।
- ৩০ সেপ্টেম্বর, হাইকোর্ট রেজিস্ট্রার অফ জয়েন্ট স্টক কোম্পানি অ্যান্ড ফার্ম (RJSC)-এর নিবন্ধককে ই-কমার্স সাইটের সমস্ত নথি জমা দেয়ার এবং কোম্পানির সম্পদ বিক্রি বা স্থানান্তর বন্ধ করার নির্দেশ দেয়।
- অনলাইন মার্কেটপ্লেস ইভ্যালির দায় মূল্যায়ন করতে হাইকোর্ট ৫ সদস্যের অন্তর্বর্তী বোর্ড গঠন করে গত ১৮ই অক্টোবর। লিখিত আদেশের পরে বোর্ড অবিলম্বে তাদের প্রথম সভা করবে, দায়গুলি মূল্যায়ন করবে, একটি অডিট কমিশন করবে এবং অন্যান্য বিষয়গুলি পরিচালনা করবে।
বোর্ডের নেতৃত্ব দেবেন শীর্ষ আদালতের সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী। একজন প্রাক্তন বিচারক, একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, একজন সচিব এবং একজন আইনজীবী বোর্ডে থাকার কথা।
- বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশিদ আলম ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ইভ্যালির দায়বদ্ধতা পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণ ও মূল্যায়নের জন্য পাঁচ সদস্যের বোর্ড গঠনের বিষয়ে ১০ পৃষ্ঠার লিখিত আদেশ প্রকাশ করেন।
- ইভালির অন্তর্বর্তী পরিচালনা পরিষদে হাইকোর্টের সম্পূর্ণ লিখিত আদেশ অনুযায়ী, গ্রাহকরা তাদের ঋণ পরিশোধের জন্য বোর্ডকে ছয় মাসের জন্য চাপ দিতে পারবেন না। তবে ভোক্তারা তাদের ঋণের বিষয়ে বোর্ড ও আদালতকে অবহিত করতে পারেন বলে আদেশে বলা হয়েছে।
- আদেশে বোর্ড সদস্যদের সম্মানী ভাতার পরিমাণও নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মতে, বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রাক্তন বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক প্রতিটি বোর্ড সভায় যোগদানের জন্য ২৫ হাজার টাকা এবং প্রতিটি বার্ষিক সাধারণ সভার জন্য ২ লাখ টাকা পাবেন।
- এছাড়া কমিটির তিন সদস্য- সাবেক সচিব মোহাম্মদ রেজাউল আহসান, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ফখরুদ্দীন আহমদ এবং ব্যারিস্টার খান মোহাম্মদ শামীম আজিজ বোর্ড মিটিংয়ের জন্য প্রত্যেকে ১০ হাজার টাকা এবং বার্ষিক বোর্ড মিটিংয়ের জন্য প্রত্যেকে এক লাখ টাকা পাবেন।
- কমিটির আরেক সদস্য, অতিরিক্ত সচিব মোঃ মাহবুব কবির বিশেষ দায়িত্ব পালন করলে তার বেতন আপাতত সরকার থেকে পাবেন। অবসর গ্রহণের পর তিনি ইভ্যালি থেকে তার শেষ বেতন পাবেন।
- এর পরে, যদি বোর্ড ইভ্যালিকে পরিচালনা করতে অক্ষম বলে মনে করে, তাহলে তারা এর অবসানের জন্য অগ্রসর হবেন। অন্যথায়, বোর্ড এটি চালাতে থাকবে এমনটা আবেদনকারীর আইনজীবী ব্যারিস্টার এ এম মাসুম বলেন। কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও চেয়ারম্যান উভয়েই বর্তমানে কারাগারে থাকায় কোম্পানি পরিচালনার বিষয়ে সবকিছুই বোর্ড করবে বলেও জানান তিনি।
- ২৩ নভেম্বর বোর্ড আদালতে অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দেবে বলে জানিয়েছেন ব্যারিস্টার এ এম মাসুম।
এটিই ছিলো ইভ্যালি পরিচালনায় হাইকোর্টের আদেশে তৈরিকৃত নতুন বোর্ড সংক্রান্ত তথ্য এবং গ্রাহকদের জন্য হাইকোর্টের আদেশ।
অধিক সংখ্যক ভোক্তা ও অর্থ লাভের আশায় ১৫০% পর্যন্ত ডিস্কাউন্ট দিয়েছিলো ইভ্যালি। শেষ পর্যন্ত এটাও জানা যায় যে, গ্রাহকদের পণ্য সরবরাহ করতে ব্যর্থ হবার পরও তাদের থেকে নেয়া অর্থ ফেরত দেয়ার কোনো পরিকল্পনা ছিল না ইভ্যালির।
অতিরিক্ত লোভের কারণে অসৎ পথে পা বাড়ানোই ছিলো ধ্বংসের দিকে নেয়া ইভ্যালির প্রথম পদক্ষেপ। ব্যবসাকে তারা শুধু ব্যক্তিগত লাভের জন্যই ব্যবহার করেছিলো। ব্যবসার যে আরও একটি উদ্দেশ্য আছে সেটি তারা আমলে নেয়নি। দেখলেনতো তার ফল?
ব্যবসা হোক বা চাকরী, সকল কাজে সর্বদা সৎ থাকা বাঞ্ছনীয়। জীবনের প্রতিটি পদে, প্রতিটি ক্ষেত্রে সততার সাথে কাজ করুন। কারণ অসৎ ও অন্যায় কাজ সাময়িক আনন্দ বা তৃপ্তি দিলেও, কখনই আপনাকে সত্যিকারের সফলতা এনে দিতে পারবে না।
আমাদের আরও ব্লগ পড়তে ক্লিক করুন এখানে
Author
Rifah Sajida Deya
Intern, Content Writing Department
YSSE