কিছু কিছু ঘটনা থাকে যা অল্প সময়ের জন্য আমাদের মনে দোলা দিয়ে চলে যায়। ঠিক যেমন ধুমকেতু দেখা দিয়ে মিলিয়ে যায়। ফুটবলে যেমন ওয়ান সিজন ওয়ান্ডার, গানের ক্ষেত্রে ওয়ান হিট ওয়ান্ডার। মোবাইল ফোন ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যাপারটা ঠিক সেরকম না হলেও এইচটিসি এর যাত্রা অনেকটা এরকম ই। এমন না যে তারা এক/দুইটা চমৎকার মডেলের ফোন উপহার দিয়ে হারিয়ে গেছে, কিন্তু একটা সময় বাজার দাপিয়ে বেড়িয়ে খুব দ্রুতই হারিয়ে যায় তারা।
এইচটিসির যাত্রা শুরু হয় তাইওয়ানে ১৯৯৭ সালে শের ওয়াং এর হাত ধরে। এর হেডকোয়ার্টার তাইওয়ানের জিন্ডিয়ান ডিসট্রিক্টে। এইচটিসি নিজেদের যাত্রা শুরু করে প্রথমত নোটবুক এর মাধ্যমে, কিন্তু ১৯৯৮ সালে তারা বিশ্বের প্রথম টাচ মোবাইল ফোন ডিজাইন করতে শুরু করে। এইচটিসির প্রথম টাচ ফোন বাজারে আসে ২০০০ সালে, এবং ২০০২ সালে তারা প্রথম উইন্ডোজ পাওয়ারড স্মার্টফোন বাজারে আনে। ২০০৫ সালে তারা ৩জি প্রসারে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। বেশ কিছু বাজার নন্দিত উইন্ডোজ ফোন এবং নিজস্ব কিছু ফোন দিয়ে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠে।
যদিও তাদের আসল জনপ্রিয়তা যেটা তারা পেয়েছিলো সেটা তখনই শুরু হয়নি। ২০০৮ সালে এইচটিসি তাদের স্বপ্নের ফোন জি-১ বাজারে ছাড়ে যা ছিলো প্রথম এন্ড্রয়েড ফোন। এরপরে তাদের আর পিছে ফিরে তাকাতে হয়নি। ২০১০ সালে এইচটিসি বিশ্বের অন্যতম ইনোভেটিভ কোম্পানি হিসেবে সুনাম অর্জন করে। ইভো ৪জি নামের ফোন বাজারে এনে তারা বিশ্বের প্রথম ৪জি সাপোর্ট করা ফোন বাজারে আনে যা পুরো বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয়।
২০১০ সালটা এইচটিসির জন্য ছিলো জাদুকরী বছরের মতো। এসময় তারা গুগলের সাথে যুক্ত হয়ে গুগল নেক্সাস ১ তৈরী করে। এটা তাদের বেশ সাফল্য এনে দেয় এবং তারা বিশ্ব বাজারের ১০ শতাংসগ দখল করে নেয়। ২০১৩ সালে এইচটিসি ওয়ান এম ৭ নামের ফোন বাজারে প্রায় ৫ মিলিয়ন কপি বিক্রি করে যা তাদের একটি দুর্দান্ত ফ্ল্যাগশিপ ডিভাইস ছিলো, এবং এই ফোনে সে সময়ের যত ফিচার মানুষ চিন্তা করতে পারে, সব ই ছিলো। ফিচারগুলার মধ্যে অন্যতম ছিলো প্রিমিয়াম মেটাল ইউনিবডি ডিজাইন, ডুয়াল ফ্রন্ট ফেসিং স্পিকার, উনত ক্যামেরা, আইআর ব্লাস্টার, ১০৮০পি ডিসপ্লে। এইচটিসির সাফল্যের পিছে মূলত দুইটি কারণ ছিলো, এর ডিজাইন এবং তাদের “সেন্স” ইউআই যেটা আন্ড্রয়েড এর উপর লেয়ার করা ছিলো। তারা প্রতি নতুন ফোনের সাথে তাদের ডিজাইন কে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে, প্রতিটা ডিজাইন দুর্দান্ত ছিলো। স্যামসাং এবং অ্যাপল কে টেক্কা দিচ্ছিলো। এমনকি তাদের সেন্সর অ্যাপল এবং স্যামসাং এর সমতুল্য ছিলো।
এতো সাফল্যের পরেও ২০১১ সাল থেকে মূলত এইচটিসির পতন শুরু হয় এবং তাদের স্বর্ণালি সময় তারা পেরিয়ে যায় একই বছরের শেষের দিকে। এসময় এইচটিসির মার্কেট শেয়ার ৬৭ শতাংশ থেকে ৩২ শতাংশে নেমে যায়। বেশ কিছু সময় শীর্ষে থাকার পরে তাদের শেয়ার এর দাম প্রায় ৭৫ শতাংশ কমে যায়। যখন তারা ফেসবুকের সাথে চুক্তি করলো, সেটাও তাদের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনতে পারেনি। এইচটিসি চাচা যেটা কিনা ফেসবুক কেন্দ্রিক ফোন ছিলো এবং তাদের আলাদা ফেসবুক বাটন ছিলো, সেটাও ফেইল করে। যখন এইচটিসির পতন ঘটে, সেসময় স্যামসাং উঠে আসতে থাকে। যখন স্যামসাং বাজারে নিজেদের যায়গা পোক্ত করে নিচ্ছিলো, এইচটিসি তখন মার্কেটে নিজেদের সর্বনিম্ন শেয়ার এর সম্মুখীন হয়।
যেখানে ২০১২ সালে এইচটিসি বিশ্বের শীর্ষ ৫ মোবাইল কোম্পানির একটি ছিলো, সেখানে ২০১৪ সালে তারা শীর্ষ ১০ মোবাইল কোমানির মধ্যেও ছিলোনা। সম্প্রতি তাইওয়ানের শেয়ার বাজারের শীর্ষ ৫০ বড় ফার্ম এর লিস্ট থেকে এইচটিসিকে সরিয়ে ফেলা হয়। তারা ধীরে ধীরে আরও পতনের সম্মুখীন হচ্ছে এবং কোন উন্নতির ছাপ নেই।
কিজন্য এইচটিসির মতো এতো সফল কোম্পানির এভাবে পতন ঘটোলো? কেবল একটা কারণ দিয়েই তাদের পতন কে ব্যাখ্যা করা যাবেনা। প্রথমত তাদের বাজে ম্যানেজমেন্ট এবং প্রোডাক্ট প্ল্যানিং এর পিছে মূল কারণগুলোর একটি। মানুষ যখন স্মার্টফোন যুদ্ধের কথা ভাবে, তখন তারা স্যামসাং- অ্যাপল এর কথা শুরুতে মাথায় আনে। অথচ একসময় বাজার মাতানো এইচটিসির কথা চিন্তাও করেনা, এখানে তাদের দুর্বল মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি প্রকাশ পায়। তাদের মার্কেট মূলত আমেরিকা এবং ইউরোপ কেন্দ্রিক ছিলো।। কিন্তু অন্যান্য ব্র্যান্ডের প্রসার ঘটার সাথে সাথে তারা আমেরিকা-ইউরোপেও মার খেয়ে যায়। এইচটিসি তাদের ট্যাগলাইন “সিম্পলি ব্রিলিয়ান্ট” এ স্থির থাকতে চেয়েছিলো, কিন্তু ফলাফল তাদের আশানুরূপ হয়নি। তাদের সবথেকে লাভজনক ইনভেস্টমেন্ট, বিটস ইলেকট্রনিক্স এর ৫১ শতাংশ শেয়ার যেটা তারা এই শেয়ারের পুরো পটেনশিয়াল বুঝার আগেই বিক্রি করে দেয়। মোবাইল ফোন হার্ডওয়্যারের ক্ষেত্রে যে ইনোভেশন, সেটাও তারা বন্ধ করে দেয়। সব মিলিয়ে তাদের বাজে ডিজাইন, মোবাইল হার্ডওয়্যার এর ক্ষেত্রে ইনোভেশনের অভাব, উচ্চ দাম, বাজে মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি ছিলো এইচটিসির পতনের মূল কারণ।
এরকম একটা পতনের পর ঘুরে দাঁড়ানো বেশ কঠিন। কিন্তু এইচটিসির সামনে এখনও সুযোগ আছে যদি তারা নিজেদের ভুল শুধরে সঠিক মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি নিয়ে আগায়। তাইওয়ানের আরেক কোম্পানি আসুস এর থেকে তারা শিক্ষা নিতে পারে যে কিভাবে মার্কেটে আবার ঘুরে দাঁড়ানো যায়। তারা যদি প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে চায়, তাদের অবশ্যই প্রচুর উন্নতি করতে হবে ফোনের এবং ভ্যারিয়েশন আনতে হবে।
আহমাদ সৈয়দ
ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE