আমাদের দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হলো ক্ষুদ্র ব্যবসা।স্বল্প পুঁজি ও জনবল নিয়ে পরিচালিত এই ব্যবসা দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক।বৃহৎ পুঁজির ব্যবসা থেকে ক্ষুদ্র ব্যবসাতেই অনেক লাভ ও সুবিধা রয়েছে। এদেশের ক্ষুদ্র ব্যবসার সিংহভাগ নারীদের দ্বারা পরিচালিত।সামাজিক,পারিবারিক বিভিন্ন জটিলতার কারণে নারীরা সাধারণত ক্ষুদ্র ব্যবসার দিকে আগ্রহী হয়।বড় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন কারণে নারীদের উপস্থিতি কম দেখা যায়।
এখনো বড় বিনিয়োগে নারীদের অধিক অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা যায় নি।বিভিন্ন কারণে এখনো নারীরা বৃহৎ পরিসরে বিনিয়োগে আসতে পারে নি।নারীদের বৃহৎ পরিসরে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় পারিবারিক ও সামাজিক দিক থেকে বাঁধা আসে।আমাদের পারিবারিক গঠনে নারীকে বাসায় বাচ্চাদের দেখাশোনা,স্বামী ও পরিবারের রান্নাবান্না,যাবতীয় সকল কিছুর বেশি খেয়াল রাখতে হয়।তাছাড়া আমাদের সমাজ ব্যবস্থাও নারীদের কাজ করার প্রতি অনেকাংশে সহনশীল নয়।সমাজের এক অকথিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে যে নারীরা ঘরের কাজ ই করবে,বাইরের উপার্জনে তাদের অংশগ্রহণের দরকার নেই।এছাড়া ভাষাগত,যোগ্যতাগত দিক থেকে ও নারীরা কর্মক্ষেত্রে বাঁধার সম্মুখীন হয়।উপযুক্ত শিক্ষা, পরিবেশ,সহযোগিতার অভাবে নারীরা পিছিয়ে থাকে এবং বৃহৎ পরিসরে তারা তাদেরকে মেলে ধরতে পারে না।
ক্ষুদ্র ব্যবসায় এদেশের বহু নারী তাদের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন এবং তাদের ব্যবসাকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন,যা শুধু তাদের জীবন নয় বরং দেশের অর্থনীতিতে অবদান রেখেছে।এমন অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে যেখানে নারীরা তাদের ক্ষুদ্র ব্যবসাকে কেন্দ্র করে তাদের জীবন গঠন করেছেন।
দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিতে ক্ষু্দ্র ব্যবসার পাশাপাশি বৃহৎ বিনিয়োগের দরকার রয়েছে।পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের সেখানে যথেষ্ট অংশগ্রহণ করা দরকার।বৃহৎ পরিসরে সফল নারীদের গল্প ও নেহাত কম নয়।
তসলিমা মিজি
আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগে তিনি এসেছেন বাংলাদেশের টেক ইন্ডাস্ট্রিতে। প্রযুক্তিকে আপন করে নিয়ে একজন নারী হিসেবে শুরু করেছেন নিজের স্বাধীন ব্যবসা। ২০১৮ সালে এসেও দেশের টেক জগতে যখন খুব একটা ‘নারী পদচারণা’ চোখে পড়ে না, তখন তসলিমা মিজির কথা অবশ্যই বলতে হয়।
স্বাধীন নারী উদ্যোক্তা তসলিমা মিজি প্রযুক্তি বিষয়ক প্রতিষ্ঠান টেকম্যানিয়া’র প্রতিষ্ঠাতা এবং চীফ এক্সিকিউটিভ অফিসার (CEO)। শুরু থেকেই প্রতিষ্ঠানটি হার্ডওয়্যার, হার্ডওয়্যার বিষয়ক বিভিন্ন সেবা এবং নেটওয়ার্কিং বিষয়ক ব্যবসার সাথে জড়িত। এটি বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির একটি নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান। একজন নারীর পক্ষে ২০০৮ সালের দিকে হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যার খাতে ব্যাবসা শুরু করা মোটেও সহজ কাজ ছিল না। ছিল প্রতিযোগিতা, নারী হিসেবে একটা খাতে প্রথম কাজ শুরু করবার প্রতিকূলতা। বিশেষ করে সাংবাদিকতার জগত থেকে উঠে আসা একজন মহিলা খুব একটা আন্তরিক পরিবেশ পাননি শুরুর সময়টাতে। কিন্তু অদম্য সাহসী মিজি থেমে থাকেননি কখনোই। নিজের প্রতিষ্ঠানের জন্য সুন্দর জায়গা নির্বাচন করে কাজ শুরু করেন তিনি। সময়ের সাথে সাথে একটু একটু করে গড়ে তোলেন তার নিজের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান, যা আজকে বাংলাদেশের কম্পিউটার ব্যবসায় নিজের জায়গা করে নিয়েছে বেশ ভালভাবেই।
সামিরা জুবেরি হিমিকা
নিজের প্রতিষ্ঠান গড়ার আগে তিনি কাজ করছেন দেশি–বিদেশি নানা যোগাযোগ বিষয়ক প্রতিষ্ঠানে। অভিজ্ঞতার ঝুলি করেছেন সমৃদ্ধ, শিখেছেন অনেক কিছুই। শেষে নিজেই আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে গড়ে তোলেন টিম ইঞ্জিন নামের প্রতিষ্ঠান, যার ম্যানেজিং ডিরেক্টর তিনি নিজেই। সামিরা জুবেরি হিমিকার কথা বলছি।
দেশের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি শেষ করে তিনি কাজ শুরু করেন ইউএনডিপিতে। পরবর্তীতে কাজ করেন বিবিসি ওয়াল্ড সার্ভিস, বাংলাদেশের ডেপুটি প্রধান হিসেবে। এরপরে কাজ করেন জিপি হাউজ আর্ট হাব নামের এক প্রজেক্টে। এটি ছিল কোনো বেসরকারি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে পরিচালিত প্রথম উদ্যোগ। প্রায় ৫–৬ বছর এভাবে কাজ করে তিনি নিজেই একদিন উদ্যোগী শুরু করেন নিজের প্রতিষ্ঠানের। এখন তাঁর প্রতিষ্ঠান ‘টিম ইঞ্জিন’ সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নানা নীতি নির্ধারণী বিষয়ে কাজ করছে।
আইভি হক রাসেল
তিনি ছিলেন একজন ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার, কিন্তু স্বপ্ন দেখতেন বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়া মহিলা জনগোষ্ঠীর জন্য কিছু করবেন। হঠাৎ করেই একদিন আইডিয়া এলো, মহিলাদের স্বাস্থ্য এবং নানা রকম সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি অনলাইন ভিত্তিক কোনো ক্যাম্পেইন পরিচালনা করতে পারেন। চাকরি ছেড়ে দিলেন, প্রতিষ্ঠা করলেন অনলাইনভিত্তিক ওয়েবসাইট– মায়া। আইভি হক রাসেলের কথা বলছি, যিনি এখন ‘মায়া আপা’ নামেই বেশি পরিচিত।
আইভি হক তার নানা উদ্ভাবনী ধারণা এবং ব্যবসাকেন্দ্রিক চিন্তা–ভাবনার জন্য সুপরিচিত। বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফাইন্যান্স এবং অর্থনীতির উপরে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে তিনি দেশে ফিরে আসেন। অনেক আগে থেকেই মানুষকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করার এক অনবদ্য প্রচেষ্টা কাজ করতো তার মধ্যে। মূলত এ কারণেই পড়াশোনার জায়গা থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে এসে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এমন কিছু করার চিন্তা করেন, যা আগে কেউ কখনো করেনি। সেই চিন্তা থেকেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন অনলাইন প্লাটফর্ম মায়ার, যা মূলত কাজ করে নারীদের নিয়েই। নারীদের জন্য দরকারি স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য এবং সামাজিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মায়ার কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এই একবিংশ শতাব্দীতে নারীদের কাছে তাদের প্রয়োজনীয় তথ্যগুলোর অবাধে যেন পৌঁছে যায়, এই ব্রত নিয়েই সামনে এগিয়ে যাচ্ছে আইভি হক রাসেলের প্রতিষ্ঠান মায়া।
তার আজকের এই অবস্থানে আসাটা কখনো সহজ হয়নি, এসেছে নানা প্রতিবন্ধকতা। তিনি শুরুর সময়টাতে কারো কাছ থেকে তেমন কোনো সাহায্যই পাননি। কিন্তু তিনি যে থেমে থাকার পাত্রী নন। কাজ চালিয়ে গিয়েছেন নানা বাঁধাকে উপেক্ষা করেই। আজ তার প্রতিষ্ঠান দেশের মহিলাদের কাছে তাদের দরকারি সব তথ্য এবং সেবা পৌঁছে দিতে কার্যকরী অবদান রাখছে। হাজারো নতুন তরুণী উদ্যোক্তার কাছে তিনি আজ এক অনুপ্রেরণার নাম।
আয়েশা আবেদ
আয়েশা আবেদের জীবন ছিল প্রকৃতই কর্মময়। আর তাঁর কর্মভাবনার মূল কেন্দ্রে ছিল এদেশের দরিদ্র মানুষ। একাধারে তিনি ছিলেন কর্মী, সংগঠক এবং পরিকল্পক, অন্যদিকে নিজের পরিবারপরিজন এবং বন্ধুদের কাছে তিনি ছিলেন স্নেহ এবং ভালোবাসার আশ্রয়।আয়েশা আবেদের বিশ্বাস ছিল সাক্ষরতা ও সচেতনতা দুটোকেই একসঙ্গে পরিচালনা করতে হবে। বয়স্কদের জন্য ব্যবহারিক শিক্ষার উপকরণ তৈরি করার প্রয়োজনে ১৯৭৪ সালে ব্র্যাক ম্যাটেরিয়াল ডেভেলপমেন্ট ইউনিট গড়ে তোলে। এই ইউনিট গড়ে তোলা এবং এর পরিচালনায় আয়েশা আবেদ অনন্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। ব্রাজিলের বিশ্বখ্যাত শিক্ষাবিদ পাওলো ফ্রেইরির দর্শন ও পদ্ধতির আলোকে বয়স্ক সচেতনতা এবং সাক্ষরতাবিষয়ক উপকরণ, স্বাস্থ্যশিক্ষা চিত্রমালা প্রভৃতি তৈরির ক্ষেত্রে তিনিই ছিলেন প্রধান দিকনির্দেশক। ব্র্যাকে ব্যবহারিক শিক্ষা কর্মসূচিতে এই উপকরণগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছে। বস্তুত, উন্নয়নকর্মকান্ডের শুধু প্রায়োগিক দিক নয়, বুদ্ধিবৃত্তিক ও দার্শনিক দিক নিয়ে সমান আগ্রহ ছিল তাঁর। বাংলাদেশের গ্রামীণ নারীসমাজ, পরিবারকাঠামোতে তাদের অবস্থান এবং তাদের ক্ষমতায়ন বিষয়ে আয়েশা আবেদ গভীরভাবে আগ্রহী ছিলেন। সামগ্রিক উন্নয়নকর্মকান্ডে নারীদের যুক্ত করে কীভাবে তাদেরকে আত্মনির্ভরশীল করে তোলা যায়, সেই ভাবনা তাঁকে আজীবন অধিকার করে ছিল। ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত ব্র্যাকের শাল্লা, মানিকগঞ্জ ও জামালপুর প্রকল্পের কর্মসূচিসমূহে দরিদ্র জনগোষ্ঠী বিশেষত গ্রামীণ নারীসমাজের জীবনসংগ্রামের সঙ্গে তাঁর নিবিড় পরিচয় ঘটে। জামালপুরের প্রকল্পটি ছিল সম্পূর্ণরূপে নারীকেন্দ্রিক। নানা ধরনের কর্মকান্ড পরিচালনা করে তিনি এ অঞ্চলের নারীদেরকে আয়বর্ধনমূলক কাজে সম্পৃক্ত করেন। একইসঙ্গে তিনি প্রত্যক্ষ করেন নারীকর্মীদের পণ্যসামগ্রী বিপণনের কোনো ক্ষেত্র নেই, অথচ এসব সামগ্রী বাজারজাত করে সহজেই তাদেরকে অর্থনৈতিক স্বয়ম্ভরতার পথে এগিয়ে নেওয়া যায়। ভাবনার এই প্রেক্ষাপট থেকেই তিনি আড়ং প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। আয়েশা আবেদের জীবন ছিল প্রকৃতই কর্মময়। আর তাঁর কর্মভাবনার মূল কেন্দ্রে ছিল এদেশের দরিদ্র মানুষ।
আয়েশা আবেদ সমাজের সুবিধাবঞ্চিত নারীদের জীবিকার সংস্থান এবং ক্ষমতায়ন নিয়ে আজীবন কাজ করে গেছেন। তাঁর সেই স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে গড়ে তোলা হয় আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশন। এই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে গ্রামীণ নারীদের উপার্জনক্ষম ও স্বাবলম্বী করে তোলার কর্মকান্ড হাতে নেওয়া হয়। এর আগে আড়ংয়ের মাধ্যমে কারুপণ্য উৎপাদনের কাজ চলছিল। এবার আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশন সেই কর্মকান্ডের আরও বিস্তার ঘটানোর উদ্যোগ গ্রহণ করে। গ্রামাঞ্চলের যেসব নারী হাতের কাজে দক্ষ ছিলেন, তাঁরা সরাসরি কাজের সুযোগ পেলেন। আর আগ্রহীদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে তাদেরকে হাতেকলমে কাজ শেখানো হলো।
এভাবে এই দেশের অনেক নারী ব্যক্তিত্ব তাদের স্বপ্নকে সত্য করেছেন এবং নিজের পাশাপাশি এই দেশের অর্থনীতিতে অবদান রেখেছেন,পথ দেখিয়েছেন সকলকে।দেশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিয়ে গিয়েছেন তারা তাদের প্রতিভায়।নারীদের বড় পরিসরে অংশগ্রহণ করে তাদের যোগ্যতার প্রকাশ করার সময় তৈরি হচ্ছে।তাদের পথচলা আরো লাখো নারীকে উৎসাহিত করবে তাদের স্বপ্ন পূরণের পথে।সকল ক্ষেত্রে নারীদের এই স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণেই এগিয়ে যাবে আমাদের দেশ
প্রস্তুতকারক,
Tasnia Nazmee
Intern