অ্যানিমেশন জগতের জাদুকর ওয়াল্ট ডিজনি গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকেই মানুষের মনোরঞ্জনের চাবিকাঠি খুঁজে পেয়েছিলেন৷ ডিজনিল্যান্ডের মাধ্যমে রূপকথার চরিত্রদের হাত ধরে কল্পনার জগতে ডুব দেওয়ার অভিজ্ঞতার সুযোগ করে দিয়েছিলেন তিনি। 

গত পর্বে আমরা ডিজনিল্যান্ডের ইতিহাস ও এটি একটি শিল্পকর্ম কিনা তা নিয়ে জেনেছিলাম। আজ আমরা জানবো এর অভ্যন্তরীণ কিছু থিম পার্ক সম্পর্কে এবং এই থিম পার্ক নিয়ে গড়ে ওঠা পুঁজিবাদ নিয়ে। সাথে থাকবে এর বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে কিছু তথ্য।

থিম পার্ক 

১৯৫৫ সালের ১৭ জুলাই সর্বপ্রথম ডিজনিল্যান্ড সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। তখন প্রায় ১৮ টি রাইড সহ ৫ টি থিম পার্ক চালু করা হয়। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ফ্রন্টিয়ারল্যান্ড, অ্যাডভেঞ্চারল্যান্ড, টুমরোল্যান্ড, এবং ফ্যান্টাসিল্যান্ডের মতো অসাধারণ কিছু থিম পার্ক।  

ডিজনিল্যান্ড কি সত্যিই আমেরিকান একটি শিল্পকর্ম?! (পর্ব ০২)

সবগুলো থিম পার্কই নিজস্ব বৈচিত্র্যতায় গড়ে তোলা। যেমন, ডিজনিল্যান্ডের অন্যতম একটি থিম পার্ক ফ্রন্টিয়ারল্যান্ড গেটওয়েটি নির্মিত হয়েছে প্যান্ডেরোসা পাইন লগ জমির দীর্ঘ তীররেখা ধরে। যেখানে আমেরিকান সভ্যতার ক্রমবিকাশ তুলে ধরা হয়েছে।  

আবার, অ্যাডভেঞ্চারল্যান্ডে আফ্রিকা, এশিয়া, আমেরিকা ইত্যাদি অঞ্চলের জঙ্গলগুলোর মতো বন্য পরিবেশ গড়ে তোলা হয়। যারা সভ্যতাকে ভুলে গিয়ে কিছুক্ষণের জন্য হলেও প্রাকৃতিক পরিবেশে হারিয়ে যেতে চান তাদের জন্যই মূলত এই অ্যাডভেঞ্চারল্যান্ড।   

অন্যদিকে, ভবিষ্যৎ দুনিয়ার মতো করে তৈরি করা এক  কাল্পনিক জগত হলো ডিজনির টুমরোল্যান্ড। এখানকার অসাধারণ সব রাইডে সবাই নিজেকে নিমিষেই যেন হারিয়ে ফেলেন বর্তমান থেকে ভবিষ্যতের জগতে। মজার রাইডগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হল রিভারবোট রাইড। রিভারবোট রাইডে চড়ে টম সয়ার আইল্যান্ডের চারপাশ ঘুরে দেখা যায়। টম সয়ার আইল্যান্ডে বেড়াতে এলে প্রতিটি শিশুই এর প্রেমে পড়ে যায়।

ডিজনিল্যান্ড কি সত্যিই আমেরিকান একটি শিল্পকর্ম?! (পর্ব ০২)

এরপর যার কথা না বললেই নয়, তা হলো ফ্যান্টাসিল্যান্ড। ডিজনিল্যান্ডের সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি থিম পার্ক সম্ভবত এই ফ্যান্টাসিল্যান্ড। একে তৈরি করা হয়েছে জাদু এবং বাস্তবতার মধ্যে এক অপূর্ব সুন্দর মিল রেখে। এই ফ্যান্টাসিল্যান্ডে রয়েছে একটি বিশালাকার স্লিপিং বিউটি ক্যাসল এবং একটি ফ্যান্টাসি ভিলেজ।  

ডিজনিল্যান্ড কি সত্যিই আমেরিকান একটি শিল্পকর্ম?! (পর্ব ০২)

ডিজনিল্যান্ড নিয়ে গড়ে ওঠা পুঁজিবাদ 

গত দশকে থিম পার্কগুলোকে ঘিরে ডিজনির সাংস্কৃতিক আধিপত্য এবং তাদের কিছু বিজনেস স্ট্র্যাটেজির কারণে ডিজনি সম্পর্কে একটি বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছিলো। 

সমালোচকদের মতে, ডিজনির পিক্সার, লুকাসফিল্ম, মার্ভেল এবং ফক্স স্টুডিও কিনে নেওয়াতে এটি ডিজনিল্যান্ডকে একটি সাংস্কৃতিক একচেটিয়া মালিকানায় পরিণত করেছে। 

ডিজনিল্যান্ড কি সত্যিই আমেরিকান একটি শিল্পকর্ম?! (পর্ব ০২)

এবং একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, এই স্টুডিওগুলোতে ছয়টি মুভি ছিল যেগুলো ২০১৯ সালে বক্স অফিসে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় করেছে। এমনকি মহামারীর আগে ডিজনির থিম পার্ক, সিনেমা এবং নতুন স্ট্রিমিং পরিষেবাগুলো থেকে বড় অঙ্কের রেভিনিউ পাওয়া সত্ত্বেও, ২০২০ সালের অক্টোবরের দিকে তাঁরা অবিশ্বাস্যভাবে থিম পার্কে কর্মরত ৩২,০০০ কর্মচারী ছাঁটাই করে দেয়। 

আবার ডিজনিল্যান্ডের প্রবেশমূল্য নিয়েও সমালোচনার শেষ নেই। ডিজনি যেহেতু ডিজনিল্যান্ডকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী স্থান বলে দাবি করেছেন, সেই প্রসঙ্গে পল বিটি নামক একজন লেখক তার ২০১৫ সালের বুকার পুরস্কার বিজয়ী উপন্যাস ‘দ্য সেলআউট’-এ লিখেছেন, “যদি ডিজনিল্যান্ড সত্যিই পৃথিবীর  সবচেয়ে সুখী স্থান হতো তাহলে এর প্রবেশ বিনামূল্যে হবে, একটি ছোট সাব-সাহারান আফ্রিকান দেশের বার্ষিক মাথাপিছু আয়ের সমতুল্য নয়”।

ডিজনির আরেকটি শিল্পকর্মও ডিজনিল্যান্ডের অনিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদের প্রতীক হিসাবে সমালোচিত হয়েছে। সেটি হল ২০১৭ সালে শন বেকারের অসাধারণ একটি মুভি ”দ্য ফ্লোরিডা প্রজেক্ট (The Florida Project)”, যার কাহিনী রচিত হয়েছিলো ডিজনিল্যান্ডের ছায়ায় বসবাসকারী একটি কাল্পনিক পরিবারকে ঘিরে। 

ডিজনিল্যান্ড কি সত্যিই আমেরিকান একটি শিল্পকর্ম?! (পর্ব ০২)

ইন্টারনেট মুভি ডাটাবেজে এখন পর্যন্ত ৮৪,৫৬৩ টি ভোটের মাধ্যমে ৭.৬/১০ রেটিং প্রাপ্ত হয়েছে মুভিটি। ২ মিলিয়ন ডলার বাজেটের দ্য ফ্লোরিডা প্রজেক্ট মুভিটি এখন পর্যন্ত বক্স অফিসে ১১.৩ মিলিয়ন ডলার আয় করে। 

ডিজনিল্যান্ডের সমালোচকদের মতে, ডিজনিল্যান্ডকে যদি শিল্প এবং শিল্পীদের বৃহত্তর কর্পোরেট সংস্কৃতির মনোভাব থেকে আলাদা করা যায়, তাহলেই ডিজনিল্যান্ড পুঁজিবাদের বদলে একটি শিল্পকর্ম হিসেবে এর প্রাপ্য স্বীকৃতি পেতে শুরু করবে। 

বর্তমান অবস্থা

কোভিড পরিস্থিতির জন্য ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে পার্কটি বন্ধ রাখা হয়। ডিজনি কর্তৃপক্ষ জানান যে, ১৯৫৫ সালের পর মাত্র কয়েকবারই পার্কটি বন্ধ রাখা হয়েছিল। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হল প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির মৃত্যুর দিন এবং ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ার ধ্বংসের দিন।  

ডিজনিল্যান্ড কি সত্যিই আমেরিকান একটি শিল্পকর্ম?! (পর্ব ০২)

এতকিছুর পরেও ডিজনিল্যান্ডের জনপ্রিয়তা কিন্তু কমেনি বরং, দিনদিন বেড়েই চলেছে। ডিজনিল্যান্ডের ওপর বেশকিছু সিনেমাও তৈরি করা হয়েছে। ডিজনিল্যান্ড এর জনপ্রিয়তার কারণে আজীবনই পুরো পৃথিবী জুড়ে এক অনন্য ইতিহাস হয়ে থাকবে ।

কিন্তু ডিজনিল্যান্ডের এই দারুণ সব সাফল্য দেখে যেতে পারেননি ওয়াল্ট ডিজনি।  এর আগেই অর্থাৎ, ১৯৬৬ সালে তিনি মৃত্যু বরণ করেন। কিন্তু তার স্বপ্নের ডিজনিল্যান্ড এবং তার ডিজনি কোম্পানির অসাধারণ সব সৃজনশীল সৃষ্টিকর্মের মধ্য দিয়ে পৃথিবীবাসীর মনে তিনি বেঁচে আছেন এবং থাকবেন চিরকাল।   

ব্লগটির ১ম পর্ব পড়ুন এখানে।

আমাদের আরো ব্লগ পড়ুন এখানে।

Writer

Janisha Afrose

Intern, Content Writing Department

YSSE.