প্যান্ডেমিকের মধ্যেও কন্টিনিউয়াস অনলাইন ক্লাসে কতটুকু শিখতে পারছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা? নাকি হিতের বিপরীত হচ্ছে? প্রতিনিয়ত অনলাইন ক্লাস চালিয়ে যেতে শিক্ষার্থীদের সংগ্রাম করতে হচ্ছে কি?
করোনায় প্রায় এক বছর ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রয়েছে। কিন্তু পাঠদানের প্রক্রিয়া ঠিকই চলছে অনলাইনে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সবারই করতে হচ্ছে এই অনলাইন ক্লাস।
প্রথম দিকে বেশিরভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইনে ক্লাস নিতে সম্মতি না দিলেও এত দীর্ঘ সময় বন্ধের পর তারা অনলাইন ক্লাস নিতে বাধ্য হচ্ছে। এর মাঝে কিছু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম থেকেই তাদের কার্যক্রম চালু রেখেছে। গুটিকয়েক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও তাল মিলিয়েছে তাদের সাথে।
তারা অনলাইনে বিভিন্ন সফটওয়্যার যেমন, জুম, গুগল মিট, মাইক্রোসফট টিমস বা ফেসবুক লাইভের মাধ্যমে পাঠদান করে চলেছেন। বিভিন্ন পরীক্ষা নিতে এল এম এস (LMS) বা লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমেরও ব্যবহার করছে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়।
ইউনিভার্সিটি অথরিটির বক্তব্য এরকম যে, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় যাতে বাঁধার সৃষ্টি না হয় বা সেশন জটে না পড়তে হয় তাই তাদের এই উদ্যোগ নেওয়া। কিন্তু এই সিচুয়েশনে আদৌ কি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারছে শিক্ষার্থীরা? নাকি উল্টা হিতের বিপরীত হচ্ছে?
বর্তমানে বিশিষ্ট পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ফারহানা ইসলাম (ছদ্মনাম) বলেন, ” দ্বিতীয় বর্ষের শুরুর দিকে ছিলাম যখন করোনা শুরু হয়ে সব বন্ধ হয়ে যায়। এক মাসের ছুটি পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে বাড়ি গেলেও শান্তিতে থাকতে পারিনি বেশি দিন। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে শুরু হয়ে যায় টাইট সিডিউলের অনলাইন ক্লাস সমূহ।
অফলাইনে যেভাবে প্রতিদিন ২টা ক্লাস ১.৩০ ঘণ্টা করে হতো, অনলাইনে একইভাবে ক্লাস হতে শুরু করল। ক্লাসে জয়েন করা, অ্যাটেন্ডেন্স নেওয়া সবমিলিয়ে ২ঘন্টাও অতিক্রম করে যেত অনেক সময়। প্রথম দিকে এভাবে ক্লাস করতে ভালোই লাগত। নতুন একটা এক্সপেরিয়েন্স। ভালই লাগত যখন ভাবতাম আমি কি করছি, আদৌ ক্লাস করছি কিনা, করলেও কীভাবে করছি, কেউই তা দেখতে পারছে না! মজাই লাগতো।
দ্বিতীয় বর্ষের প্রথম সেমিস্টার কাটলো এভাবেই। কিন্তু যতই দিন যেতে লাগল ততোই মনোযোগ হারাতে শুরু করলাম। দেড় ঘন্টার ক্লাস গুলো করার সময় মনে হতো যুগ যুগ ধরে ক্লাস করছি। কেন জানিনা কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারছিলাম না পড়াশোনায়! ফেসবুক, ইউটিউব সারাদিন ঘণ্টার পর ঘন্টা ব্রাউজ করলে কিছু হয় না! একগাদা বই পড়ে শেষ করে ফেলতে কিছু হয় না! কিন্তু মাত্র দেড় ঘণ্টার অনলাইন ক্লাসে মনোযোগ দিতে নিজের সাথে এত যুদ্ধ করতে হয় জানতাম না!
এদিকে ক্লাস হচ্ছে ওদিকে খবর পাচ্ছি হাজার হাজার লোক মারা যাচ্ছে। ফোনে কল আসলেই ভয় লাগে, এই বুঝি কেউ খারাপ খবর দেওয়ার জন্য ফোন দিল! খবরের কাগজ খুললেই বড়ো বড়ো মোটা অক্ষরে লেখা গত ২৪ ঘণ্টায় কত জন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো! গণমাধ্যমে শুধু নিউজ আর নিউজ! লকডাউনে মানুষের চাকরি নাই, খাওয়ার জন্য খাবার নেই! সেখানে ইউনিভার্সিটি গুলো যদি এত বড় বড় অ্যামাউন্ট এর সেমিস্টার ফি চার্জ করে সেটা একটা মিডিল ক্লাস ফ্যামিলির স্টুডেন্ট এর জন্য নিছক বিলাসিতা ছাড়া কিছুই না!
এতো কিছুর মাঝেও ক্লাসে অ্যাটেনডেন্স এর জন্য কড়াকড়ি দেখে মাথাই নষ্ট! ১০ মিনিটের মধ্যে জয়েন না করলে নাকি অ্যাটেনডেন্স দিবে না, ক্লাসে অ্যালাও করবেনা। তাহলে কারো যদি কোনোদিন নেটওয়ার্ক প্রবলেম থাকে আর লেট হয় তাহলে ওইদিন তাকে ঢুকতে দেওয়া হবে না ক্লাসে! তাছাড়া প্রতিদিন বিভিন্ন টাস্কের বন্যা যেমন, ক্লাস টেস্ট, মার্কস বিহীন হাজারো অ্যাসাইনমেন্ট, বড় বড় রিসার্চ প্রপোজাল, টার্ম পেপার প্রেজেন্টেশন তো রয়েছেই!
যাইহোক কোনোভাবে সেমিস্টার শেষ হলো। পরপর দুই টা সেমিস্টার একই ভাবে চললো। অ্যাটেনডেন্স শিট টা দেখলাম আমার। ২/১ টা ক্লাস বাদে সবগুলোই প্রেজেন্ট। কিন্তু পুরো সেমিস্টার জুড়ে কি শিখলাম কিচ্ছু জানিনা! নট এ থিং! আমার কথা শুনে মনে হচ্ছে অনেক বাজে স্টুডেন্ট তাইনা? হতে পারে। প্রথম সেমিস্টারের রেজাল্ট ৩.৮০ আউট অফ ৪.০০, দ্বিতীয় সেমিস্টারে ৩.৭০। হ্যা, খুব একটা ভালো স্টুডেন্ট না আমি। পড়াশোনার অদম্য ইচ্ছা নিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু অনলাইন ক্লাস করতে করতে আমার পড়াশোনার ইচ্ছা সব ধুলোয় মিশে গেছে!
একদিন নোটিশ পেলাম সেমিস্টার ফাইনাল!! শুনেই তো বুক শুকিয়ে গেলো। কিছুই তো পড়ি নাই এই সেমিস্টারে। কি লিখব পরীক্ষায়!! জানিনা!! বুঝতে পারছিলাম অনেক গ্যাপ পড়ে গেছে আমার জানায়। কিন্তু কোন ভাবেই তা কাটিয়ে উঠতে পারিনি শত চেষ্টার পরেও। হতাশা আর নিরাশায় দিন যাচ্ছিলো। এর মাঝেই ২টা সেমিস্টার ফাইনাল দিলাম। নতুন বছর শুরুর সাথে সাথে নতুন সেমিস্টার ও শুরু হলো।
এটা দিয়ে প্রায় ৩ টা সেমিস্টার হলো আমাদের অনলাইনে। ফাইনাল পরীক্ষা ২ টির রেজাল্ট দেখে আরও হতাশায় পড়ে গেলাম। রেজাল্ট এতটাই ড্রপ করেছে যে শেয়ার করার মত না। ভেবেছি এইবার যেভাবেই হোক ভালো করবো। পড়তে ইচ্ছেও করে অনেক কিন্তু পারিনা! এ যেন এক অন্যরকম অশান্তি! মনে হয় অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি পুরোটা সময়। কিছু শেখাতো দূরে থাক! উল্টা মনে হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলোর এ এক অমানবিক মানসিক অত্যাচার আমাদের উপর! দেশের মানুষের, নিজের আত্মীয় স্বজনের জীবন-মরণ অবস্থা আর অথরিটি বলে তাদের প্রতিষ্ঠানে নাকি সেশন জট কোনো ভাবেই অ্যালাও করা যাবেনা!”
প্রতিদিনই ফারহানার মত মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে হাজার হাজার মেধাবী শিক্ষার্থীরা। ফ্রাস্ট্রেশন আর ডিপ্রেশনে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে তাদের ফিউচার ক্যারিয়ার। সবার একটাই চাওয়া। ক্লাসগুলো যেন ফিজিক্যালি নেওয়া হয়। একটা স্ক্রীনের দিকে ঘণ্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে মনোযোগ সহকারে কোনো কিছু করা কারো পক্ষে একেবারেই সম্ভব নয়।
এখন যেহেতু ইন্ডিয়ার নতুন ভ্যারিয়ান্ট এর করোনার জন্য লকডাউন আরও বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে, চোখের পলকে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, মৃত্যুর হার অনেক বেড়েছে, এখন ফিজিক্যালি ক্লাস নেওয়া অবশ্যই সম্ভব নয়। আবার তারা অনলাইন ক্লাস বন্ধ করতেও উৎসাহী নয়। সেখানে মানবিকতার খাতিরে শিক্ষকদের স্টুডেন্ট এর সাথে একটু ফ্লেক্সিবল হওয়া উচিত। তাদের উপর সহানুভূতিশীল ভাবে ডিল করা উচিত। তাদের সব ক্লাসের রেকর্ডিং প্রোভাইড করা উচিত। যাতে যাদের নেটওয়ার্ক প্রবলেম হয় তারা যেন কোন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
মানসিকভাবে শিক্ষকরাও হয়তো ভালো নেই। কিন্তু একবার চিন্তা করুণ, একটা স্টুডেন্ট চারিদিকে সবার এই অবস্থা দেখার পরেও কিভাবে শত শত টার্ম পেপার, অ্যাসাইনমেন্ট করতে মনোযোগ দিতে পারে! কিভাবে প্রতিদিন পরীক্ষা দিয়ে যেতে পারে! কিভাবে দিনে ৪ ঘণ্টা মনোযোগ দিতে পারে ক্লাসে! এই অবস্থায় কি এগুলো মওকুফ করা কি এতটাই অসম্ভব কিছু? এতটা গুরুত্বপূর্ণ এগুলো! মানুষের জীবনের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ!
এছাড়া, অথরিটি নাকি স্টুডেন্টদের ওয়েলনেস এর কথা বলে, আবার তারাই অনলাইনে পুরো সেমিস্টার শেষ করে অফলাইনের জন্য ফাইনাল পরীক্ষা পোস্টপোন করে নতুন একটা সেমিস্টার শুরু করে এবং সেই ২টা সেমিস্টার ফাইনাল একবারে নেওয়ার নোটিশ দেয়। এর চেয়ে বড় ডিজাস্টার আর কিছু হতে পারে কি একটা শিক্ষার্থীর জন্য?
Author
Mst. Suraia Khanam
Intern, Content Writing Department
To read more click here.