সারাবছর আমরা যেমন ইদের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করি ঠিক তেমনি দেশের অনেক মানুষ জুন মাসের জন্য অপেক্ষা করে । কারণ এই জুন মাস , রাষ্ট্রের আয় -ব্যয় সম্পর্কে অবহিত হওয়ার মাস।এই সময়টায় দেশের অর্থবছরের বাজেট প্রণয়ন করা হয়।
আমাদের প্রত্যেকের জীবনযাপনের জন্য যেমন একটি বাজেট থাকে ঠিক তেমনি রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সরকার কোথায়, কিভাবে আয়-ব্যয় করছে সেটারও একটা বাজেট থাকে। রাষ্ট্রের এই আয়- ব্যয়ের হিসাবটি হয় প্রতিবছরের ১ জুলাই থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত। রাষ্ট্রের এই বাজেটের জন্য সবাই আগ্রহী থাকে কেননা বাজেটের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত আমাদের খুচরা বাজার ও জীবন যাপনে দারুণ প্রভাব ফেলে।
এদিকে জেনে রাখা ভালো যে আমাদের ব্যক্তিগত বাজেট যেমন পুরোটাই আয়ের উপর নির্ভরশীল অর্থাৎ আমরা আমাদের আয় অনুযায়ী ব্যয় করলেও রাষ্ট্রীয় বাজেটে তেমনটি হয় না। রাষ্ট্রীয় বাজেটে প্রথমে খরচের খাত ও পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়।
রাষ্ট্রের এই বাজেটের প্রাণভোমড়া হচ্ছে “ফিসকাল পলিসি “( Fiscal Policy) . বাজেট দেওয়ার ক্ষেত্রে এটিই হলো সর্বপ্রথম ধাপ। একে কেন্দ্র করেই সরকার বাজেট প্রণয়ন করে। এই ফিসকাল পলিসি অনেক ধরণের হয়ে থাকে। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে সম্প্রসারণশীল ধাপ।
আমাদের বাংলাদেশের বাজেট হচ্ছে সম্প্রসারণশীল বাজেট। অর্থাৎ দেখবেন, আমাদের দেশের বাজেটের পরিমাণ দিন কে দিন বেড়েই চলছে। এই সম্প্রসারণ নির্ধারণ করা হয় “মুদ্রাস্ফীতির” উপর নির্ভর করে। এছাড়াও সম্প্রসারণের অন্যতম কারণ হচ্ছে সরকারের বিভিন্ন খাতের উপর গুরুত্ব দেওয়া। সহজ ভাষায় যেই খাতে গুরুত্ব বেশি , সে খাতে বরাদ্দ বেশি হওয়ার ফলে সামগ্রিক বাজেট বাড়তে থাকে। তাই অনেকসময় মুদ্রাস্ফীতিকে একমাত্র বিবেচক হিসেবে ধরা হয় না।
সাধারণ মানুষের জন্য বাজেটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো – আয়কর ও ভ্যাট এর হ্রাস- বৃদ্ধি। কারণ এই বিষয়গুলোর সাথে আমাদের সরাসরি সংযোগ রয়েছে। পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেলে ভ্যাট বৃদ্ধি পায় আবার কর আরোপের ফলে নানা শ্রেণীর মানুষের এই কর কম না বেশি হলো সেই প্রশ্ন জাগে ।
বেশ কিছু বছর ধরে যেমন আমরা দেখছি কম আয়ের মানুষের ক্ষেত্রে তুলনামূলক অতিরিক্ত কর আরোপ করা হচ্ছে যা খুব প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে।
বাজেটের মাধ্যমে সরকারের বিভিন্ন আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটে । ভ্যাট হ্রাস- বৃদ্ধির মাধ্যমে পণ্যের অবাধ ব্যবহারের পথ সুগম অথবা দুর্গম তা জানা যায়। সাধারণত সরকার সবসময় জনবান্ধবমূলক বাজেট প্রণয়নের চেষ্টা করে।
বাজেট ২০২১ –২২
করোনার থাবায় জনজীবন বিপর্যস্ত। তার প্রভাব পড়েছে অর্থনীতিতেও ! দেশের একমাত্র সম্বল হিসেবে প্রবাসীদের রেমিটেন্স ই বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস হিসেবে দাঁড়িয়েছে। যদিও এটি টেকসই কোন উৎস নয়, এছাড়াও দেশের ব্যবসা বাণিজ্যেরও বেহাল অবস্থা। গত অর্থবছরে রপ্তানী থেকে তেমন কোনো আয় আসে নি বললেই চলে। এই বেহাল অবস্থার কথা মাথায় রেখে গত ৩রা জুন অর্থমন্ত্রী মোস্তফা কামাল দেশের পঞ্চাশতম বাজেট উত্থাপন করেন।
তো কি আছে এই বাজেটে জেনে নিই –
বাংলাদেশের ইতিহাসের ৫০ তম বাজেটের আকার ছয় লাখ তিন হাজার ছয়শত একাশি কোটি টাকা যা দেশের সবচেয়ে বড় বাজেট। বাজেটটি মোট জিডিপির প্রায় সাড়ে সতের শতাংশ দখল করবে বলে জানা গেছে। এছাড়াও প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ৭.২ শতাংশ। বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ প্রায় দুইলক্ষ ১২ হাজার ৪৩৩ কোটি টাকা। জানা গেছে এই ঘাটতির সিংহভাগ আসবে বৈদেশিক ঋণ থেকে। এছাড়াও ব্যাংক থেকে প্রায় ৭৬ হাজার কোটি টাকার ঋণও নেওয়া হবে।
অর্থমন্ত্রীর মতে , ‘এইবারের বাজেট ব্যবসাবান্ধব একটি বাজেট।’ এবারের বাজেটে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে জীবন জীবিকা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা , কর্মসংস্থান, ব্যবসা বাণিজ্য , বিনিয়োগ ও কৃষিখাতে। প্রস্তাবিত এই বাজেটকে তিন ভাগ করা হয়েছে।
- সামাজিক অবকাঠামো
- ভৌত অবকাঠামো
- সাধারণ সেবা খাত
সামাজিক অবকাঠামোতে ১ লাখ ৭০ হাজার ৫১০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দের পরিমাণ ১ লাখ ৭ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা। যোগাযোগ ও অবকাঠামো খাতে ৬৯ হাজার ৪৭৪ কোটি টাকার বরাদ্দ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এছাড়াও বিদ্যুৎ ও জ্বালানী খাতে ২৭ হাজার ৪৮৪ কোটি, করোনা মোকাবেলায় আলাদাভাবে ১০ হাজার কোটি টাকা এবং স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ পড়েছে ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষায় ২৬ হাজার ৩১১ কোটি টাকা, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় ৩৬ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। মূলত শিক্ষাখাতে মোট জিডিপির মাত্র ২.২ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জন্য ৪ হাজার ১৯১ কোটি টাকা,তৈরি পোশাক খাতে ১ শতাংশ হারে রপ্তানি প্রণোদনা চালু রাখাসহ পরিচালনাসহ অন্যান্য খাতে মোট বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকার মতো।
বাজেটের রাজস্ব আয় হিসেবে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা আশা করা হচ্ছে যার ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা আসবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে।
চলুন এবার বাজেটের কিছু নতুন পদক্ষেপের কথা জেনে আসি।
মেড ইন বাংলাদেশ
এইবারের বাজেটে বাইরের দেশে থেকে আমদানী নির্ভরতা কমানোর উদ্দ্যেশ্যে স্থানীয়ভাবে উৎপাদনে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
- দেশের কৃষিখাতকে আরো বিকশিত করার জন্য কৃষিজাত পণ্য, কৃষি উপকরণ, ও কৃষি ব্যবসাকে কর অবকাশের আওতায় আনা হয়েছে। দেশের চাষিদের সুবিধার জন্য আমদানীকৃত গাজর ও মাশরুমে শুল্কহার বাড়ানো হয়েছে। কৃষিকাজে ব্যবহার হওয়া নানা মেশিনের উপর ও আগাম কর অব্যাহতির কথা জানানো হয়েছে।
- হালকা প্রকৌশলশিল্প গুলোও যেন বিকাশ লাভ করতে পারে সেজন্য থ্রি হুইলার, ফোর হুইলার উৎপাদনেও কর অবকাশের সুবিধা রাখা হয়েছে।
- নারীদের মালিকানাধীন ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ ও করের আওতামুক্ত। বার্ষিক ৭ লক্ষ টাকার নিচে টার্নওভার আছে এমন SME কে এই সুযোগের আওতায় রাখা হবে।
- গৃহস্থালিকাজে ব্যবহৃত পণ্যের উৎপাদনে ভ্যাট না রাখা ও আগাম করের প্রস্তাব রয়েছে। এতে করে মিক্সচার, গ্রাইন্ডার, ইলেক্ট্রিক কেটলি, রাইস কুকার, প্রেশার কুকারের মতো দেশীয় উৎপাদিত পণ্যের জন্য ভ্যাট দিতে হবে না।
মোট কথা আগামী দশ বছরে দেশের মধ্যে উৎপাদিত পণ্যের উপর এই ধরণের কর ও ভ্যাট মওকুফ করে “Made in Bangladesh” ব্র্যান্ডকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাত
২০২১-২২ অর্থবছরে ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশনে বিদ্যমান ২২ টি খাতের পাশাপাশি আরো ছয়টি খাতকে করমুক্ত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
এই খাতগুলো হলো-
- ক্লাউড সার্ভিস
- সিস্টেম ইমিগ্রেশন
- ই লার্নিং প্ল্যাটফর্ম
- ই –বুক পাবলিকেশন
- মোবাইল অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট সার্ভিস
- আইটি ফ্রিল্যান্সিং
এই খাতে ২০২৪ সাল পর্যন্ত কর অবকাশ থাকবে।
এছাড়াও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২১ হাজার ২০৪ কোটি টাকা। পাশাপাশি ডাক ও টেলিযোগাযোগে দেওয়া হয়েছে ২ হাজার ৫৪৯ কোটি টাকা। আইসিটি সেক্টরে বরাদ্দ পাচ্ছে ১৭২১ কোটি টাকা।
বাঁচার জন্য বাজেটের দ্বিতীয় পর্বের জন্য আমাদের সাথেই থাকুন ।
দ্বিতীয় পর্ব পড়ে আসুন। বাঁচার জন্য বাজেট ! ( পর্ব – ২)
আমাদের আরো ব্লগ পড়ুন এখানে
শেখ সাব্বির ইসলাম মাহি
ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE