দেশের জলবায়ু , আবহাওয়া, ভৌগোলিক অবস্থিতি বা উৎস এর উপর নির্ভর করে প্রতিটি দেশে উৎপাদিত পণ্য সমূহের ধরণ আলাদা হয় তবে কিছু পণ্যের সাথে মিল তো থেকেই যায়। কোনো একটি দেশের মাটি, পানি, আবহাওয়া এবং ওই জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি যদি কোনো একটি পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তাহলে সেটিকে ঐ দেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। অর্থাৎ সেই পণ্য শুধু ওই এলাকা ছাড়া অন্য কোথাও উৎপাদন করা সম্ভব নয়।
ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য, সংক্ষেপে জি আই হচ্ছে কোনো সামগ্রীর ব্যবহার করা বিশেষ নাম বা চিহ্ন। ভৌগোলিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সামগ্রী নির্দিষ্ট গুণগত মানদণ্ড বা নির্দিষ্ট প্রস্তুত প্রণালী অথবা বিশেষত্ব নিশ্চিত করে আর এই নির্দিষ্ট পণ্য বা জিআই পণ্য হিসেবে পরিচিত হওয়ার জন্য প্রয়োজন শিল্প মন্ত্রণালয়ের স্বীকৃতি। কোনো দেশের ভৌগোলিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বিভিন্ন সামগ্রী নির্দিষ্ট অঞ্চলটিতে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করার অধিকার এবং আইনি সুরক্ষা প্রদান করে।
বাংলাদেশের প্রথম ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হলো জামদানি। বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যগুলোকে নিবন্ধন দিতে সরকার ২০১৩ সালে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন করেছে। ২০১৫ সালে এ আইনের বিধিমালা তৈরি হয় এবং জিআই পণ্যের নিবন্ধন নিতে আহ্বান জানায় ডিপিডিটি। এরপর প্রথম বিসিক জামদানির জন্য আবেদন করে ২০১৭ সালের ১৭ ই নভেম্বর জামদানি নিজস্ব পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এ সম্পর্কে তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, “বিশ্বে বাংলাদেশের যে কয়টা পণ্য সুপরিচিত, জামদানি এর অন্যতম। জামদানিকে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে নিবন্ধনের মাধ্যমে দেশীয় ঐতিহ্য সুরক্ষার পথে বাংলাদেশ এক ধাপ এগিয়ে গেল”।
জামদানির পর মৎস্য অধিদপ্তর রুপালি ইলিশের জন্য আবেদন করে এবং ২০১৭ সালের ৬ই আগস্ট বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য হিসেবে ইলিশ সারা বিশ্বে স্বীকৃতি পায়। এরই ধারাবাহিকায় ক্ষীরশাপাতি আমের জিআই নিবন্ধন পেতে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ২০১৮ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি পেটেন্ট ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক অধিদপ্তরের রেজিস্ট্রারের কাছে আবেদন করে এবং এর প্রেক্ষিতে ২৭ জানুয়ারি ২০১৯ তারিখে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ক্ষীরশাপাতি আমকে বাংলাদেশের ৩য় জিআই পণ্য (foodstuff) বা ভৌগোলিক নির্দেশক হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
জামদানি, ইলিশ ও ক্ষীরশাপাতি আমের পর এবার ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (জিআই) হিসেবে নিবন্ধন পেল ঢাকাই মসলিন, রাজশাহীর সিল্ক, রংপুরের শতরঞ্জি, দিনাজপুরের কালিজিরা, কাটারিভোগ ও বিজয়পুরের সাদা মাটি। ফলে এগুলোও বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য হিসেবে সারা বিশ্বে স্বীকৃতি পেল। ২০২০ সালের ২৮ ডিসেম্বর মসলিনকে বাংলাদেশের চতুর্থ জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় আর ২০২১ সালের ২৬ এপ্রিল রাজশাহী সিল্ক কে ৫ম,শতরঞ্জি কে ৬ষ্ঠ, চিনিগুড়া চাল কে ৭ম, দিনাজপুরের কাটারিভোগ কে ৮ম এবং বিজয়পুরের সাদা মাটি কে ৯ম জিআই পণ্য বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, গত ফেব্রুয়ারিতে এ বিষয়ে সব দাপ্তরিক কাজ চূড়ান্ত হলেও শিল্প মন্ত্রণালয় এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেয়নি। আগামী মাসে ঘোষণা দেওয়া হতে পারে। এ আবহে ২০২১ সালের ২৬ এপ্রিল পালিত হয়েছে বিশ্ব মেধাসম্পদ দিবস। যেখানে দিবসটি উপলক্ষে অনলাইনে শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরের উদ্যোগে এক সেমিনারের আয়োজন করেছে। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিল ‘মেধাস্বত্ব ও এসএমই : পরিকল্পনা গ্রহণ ও বিপণন’।
মেধাসম্পদ দিবসে জিআই পণ্য সম্পর্কে ২৫শে এপ্রিল, রবিবার শিল্প সচিব কে এম আলী আজম কালের কণ্ঠকে বলেন, অনেক লম্বা দাপ্তরিক প্রক্রিয়া শেষে গত ফেব্রুয়ারিতে ঢাকাই মসলিন, রাজশাহীর সিল্ক, রংপুরের শতরঞ্জি, দিনাজপুরের কালিজিরা, কাটারিভোগ ও বিজয়পুরের সাদা মাটি বাংলাদেশের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতির সব দাপ্তরিক কাজ চূড়ান্ত হয়েছে। তবে সরকারের পক্ষে এখনো ঘোষণা দেওয়া হয়নি। আগামী মাসের মধ্যে ঘোষণা দেওয়ার পরিকল্পনা আছে।
ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (সংক্ষেপে জিআই) হচ্ছে মেধাসম্পদের অন্যতম শাখা। এটি অনন্য গুণ-মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যা নির্দিষ্ট এলাকা ছাড়া একই গুণ-মানসম্পন্ন সেই পণ্য হিসেবে অন্য কোথাও সাধারণত উৎপাদন করা সম্ভব হয় না। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দিক থেকে বাংলাদেশ সমৃদ্ধিশালী হলেও দীর্ঘ সময় ধরে জিআই আইন না থাকায় এ দেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের মালিকানা সুরক্ষার সুযোগ ছিল না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন, ২০১৩ এবং ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) বিধিমালা, ২০১৫ প্রণয়ন করার পর দেশের ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য নিবন্ধনের পথ সুগম হয়।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি) দেশের ঐতিহ্যবাহী পণ্যগুলোকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এই জিআই পণ্য গুলো বিশ্বে আমাদের দেশের প্রতিনিধিত্ব করে এবং শুধু প্রতিনিধিত্ব নয় এর পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। তাই এসব পণ্যকে তাদের যথাযথ স্বীকৃতি ও নিরাপত্তা দিয়ে দেশীয় ঐতিহ্য সুরক্ষা করা দেশের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য। এই দায়িত্ব-কর্তব্য পালনের মাধ্যমে নিজেদের পণ্য গুলোকে রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমেই দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব। আর তবেই দেশ ও জাতি সমৃদ্ধির পথ এগিয়ে যাবে।
You can check our other blogs here: https://ysseglobal.org/blog/nadir-on-the-go-দ্যা-ভ্রমণ-পিপাসু/
Author
Mahmuda Sultana
Intern, Content Writing Department
YSSE