প্রতিদিনের ব্যস্ত জীবনে নিজের সৃজনশীলতা এবং সৃষ্টিশীলতাকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে একটি ধারণার জন্ম দিয়েছেন মাইক্রোসফটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ধনী বিল গেটস। তার ধারণাটির নাম হলো ‘থিঙ্ক উইক’। ‘থিঙ্ক উইক’ মূলত এমন একটি সপ্তাহ, যখন গেটস নিজের বিক্ষিপ্ত মনকে কেন্দ্রীভূত করার লক্ষ্যে অন্য সবকিছু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে একা একটি জায়গায় একটি সপ্তাহ কাটাতেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত আমরা ব্লগের প্রথম অংশে দেখেছি।
এখন অনেকের মনেই প্রশ্ন আসতে পারে যে, ‘আমাদের তো বিল গেটসের মতো এরকম কোনো বিশাল প্রতিষ্ঠান নেই, দুতলা কেবিন নেই তাহলে আমার এমন থিঙ্ক উইকের কী দরকার!’
থিঙ্ক উইক কাটানোর জন্য যে বিল গেটসের মতো বিশাল কোনো ব্যক্তিত্ব হতে হবে এমন কোনো শর্ত নেই। আপনি যদি একজন সৃষ্টিশীল মানুষ হন এবং এটি উপলব্ধি করেন যে, কর্মজীবনের নিষ্পেষণে আপনি আপনার সৃষ্টিশীল মনকে ঠিকমতো চিন্তা করার সুযোগ করে দিতে পারছেন না, তাহলে আপনিও চাইলেই পারেন বছরে অন্তত এমন একটি থিঙ্ক উইক কাটাতে, যখন আপনি একদম একাকী-নিঃসঙ্গ অবস্থায়, জাগতিক সকল দুর্ভাবনাকে পেছনে ফেলে সময়টা কেবলই নিজের মতো করে কাটাবেন। আপনার নিজের কমফোর্ট জোনের যেকোনো জায়গায় কাটাতে পারেন এই সপ্তাহটি,এটা হতে পারে আপনার বেডরুম বা পছন্দের কোনো জায়গা।
থিঙ্ক উইক যে শুধু আপনাকে সৃজনশীল, চিন্তাশীল হতে সাহায্য করবে তা কিন্তু নয়, আপনার ক্লান্ত জীবনকে অনেকটাই ট্র্যাকে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে। যেমনঃ
- নতুন এক নিজেকে আবিষ্কার করতে পারবেন থিঙ্ক উইকে। দিনের পর দিন এরকম কাজের প্রেসারে কাজ করতে করতে আপনি হয়তো নিজেকে হারিয়ে ফেলছেন নিজের অজান্তেই। অন্যের দৃষ্টিভঙ্গিতে নিজেকে মূল্যায়ণ করতেই আপনি অভ্যস্ত আপনি কে, আপনি নিজে কি চান, আপনার সক্ষমতা কতটা এসব প্রশ্নের উত্তর আপনাকে দিতে পারে একটি থিঙ্ক উইক। যখন আপনি এই ব্যস্ততা থেকে খানিকটা সরে গিয়ে সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে নিজের মতো করে থাকতে পারবেন, আপনার আশেপাশে কেউ আপনাকে মনিটর করবে না, পদে পদে আপনার ভুল ধরবে না, আপনাকে বিচার করবে না, তখন আপনি যা যা করবেন, সব শুধু নিজের জন্যই করবেন, অন্য কাউকে ইমপ্রেস করতে নয়। এভাবে আপনি নিজের রুচিবোধ ও পছন্দ-অপছন্দ সম্পর্কেও ধারণা পেয়ে যাবেন।
- নতুন কোনো ধারণা বা আইডিয়ার প্রকাশ করতে সাহায্য করে থিঙ্ক উইক। রুটিনমাফিক জীবনে আপনার সৃজনশীল ভাবনাগুলো হয়তো ঠিকভাবে প্রকাশ পাচ্ছে না। প্রতিদিনই একইরকম জিনিস দেখতে, একই জিনিস শুনতে এবং একইরকম কাজ করতে করতে, আপনার ভাবনাগুলোও এর থেকে বের হতে পারছে না। আউট অফ বক্স(Out of box) কিছু ভাবতে পারছে না। যখন আপনি একটা আলাদা পরিবেশে একা কিছুদিন কাটাবেন, আপনার বিক্ষিপ্ত ভাবনাগুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন, তখন নতুন অনেক ধারণার উৎপত্তি হতে পারে।
- যেকোনো কাজ সুষ্ঠুভাবে করতে প্রয়োজন যথাযথ ফোকাস। থিঙ্ক উইক আপনার সৃষ্টিশীল ভাবনাগুলোকে সর্বোচ্চ ফোকাসের সাথে ভাবার সুযোগ করে দিবে। কর্মস্থলে বস থেকে শুরু করে সহকর্মী সবার অর্ডার মেনে ডেডলাইন মেইনটেইন করে আপনার পক্ষে নিজের চিন্তার ফোকাস ঠিক রাখা খুবই কঠিন হয়ে যায়। তাই থিঙ্ক উইকে একেবারে একা, কাজের প্রেসার ছাড়া সর্বোচ্চ ফোকাস দিয়ে কিছু চিন্তা করতে পারেন, যার দরুণ আপনি দারুণ একটা কিছুর উদ্ভাবন করে ফেলতেই পারেন।
- থিঙ্ক উইক আপনাকে মনের পাশাপাশি শারীরিক উন্নতি ঘটাতেও সাহায্য করে। থিঙ্ক উইকে প্রতিদিন ভোরে বেরিয়ে পড়েন সকালের নির্মল বাতাসে আপনি বুক ভরে শ্বাস নিতে পারবেন, হাঁটাহাঁটির মাধ্যমে আপনার হালকা ব্যায়ামও হয়ে যাবে। সেই সাথে যদি আরো কিছু শরীরচর্চাও আপনি করেন, তাহলে আপনার শরীর আরো বেশি চাঙ্গা হয়ে যাবে, যা দিনের বাকি সময়গুলোতে আপনার চিন্তার গতিকে আরো সচল করে দেবে।
- আপনি যদি থিঙ্ক উইক কাটানোর জন্য প্রকৃতির মধ্যে কোনো জায়গা নির্বাচন করে থাকেন যেমন- যেখানে প্রচুর গাছপালা, পাখি, পাহাড় কিংবা সমুদ্রও যদি থাকে তাহলে শহুরে যান্ত্রিক জীবন থেকে কিছুদিনের জন্য আপনি প্রকৃতির কাছাকাছি চলে যাওয়ার সুযোগ পাবেন। প্রকৃতির কাছাকাছি গেলে আপনার অস্থির হৃদয় যেমন শান্ত হবে, তেমনই প্রকৃতির স্নিগ্ধতা আপনার যাবতীয় দুশ্চিন্তা দূরীকরণেও সাহায্য করবে। আপনি একধরনের শান্তি অনুভব করবেন।
আপনি হয়তো জানেন যে, যখন কোনো লেখক নতুন কোনো উপন্যাসের প্লট খুঁজতে থাকে তখন প্রায়ই চলে যান শহর ছেড়ে দূরে প্রকৃতির কাছে কোথাও একা থাকতে। আবার অনেক সিরিয়াস অভিনেতাকে দেখা যায় আসন্ন প্রজেক্টে তিনি যে চরিত্রটিতে অভিনয় করবেন, সেই চরিত্রের সাথে একাত্ম হওয়ার লক্ষ্যে কিছুদিনের জন্য কোথাও গিয়ে একা থাকছেন। তারা এই কাজগুলো কেন করেন? তারা এই কাজগুলো মূলত তাদের পরবর্তী কাজে যাতে ভালোভাবে ফোকাস করতে পারেন এবং নিজের বেস্টটা যাতে দিতে পারেন তাই তারা একটু আলাদা কোথাও চলে যান। তাদের এই কাজগুলো লক্ষ্য করলেই আমরা বিল গেটস -এর থিঙ্ক উইক ধারণাটি দেখতে পাই। এই ‘থিঙ্ক উইক’ টার্মটি আমাদের কাছে অপরিচিত হলেও লেখক বা অভিনেতাদের এই কাজগুলো আমাদের কাছে এখন পরিচিত, কারণ আমরা এই ব্যাপারটির সাথে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি যে সৃজনশীল মানুষদের নিজ কাজের জন্য বিরতি প্রয়োজন হয়। এর মাধ্যমে কাজে ফোকাস বাড়ে, ফলে কাজের গুণমান বাড়ে। শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যও ঠিক থাকে। মনোবিজ্ঞান স্বীকার করে যে, কয়েকটা দিন প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে কাটালে শরীর-মন অনেকটা শুশ্রূষা পায়। রোজকার জীবন থেকে ক্ষণিকের বিরতি নিয়ে আপনি ঠান্ডা মাথায় নিজের সমস্যাগুলোর জট ছাড়াতে পারবেন। নিজেকে নতুন করে আবিষ্কারের সুযোগ পাবেন।
এরকম আরও ব্লগ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
Jannatul Bari
Intern, Content Writing Department
YSSE