বীমা কোম্পানিগুলোর শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে অস্থির পুঁজিবাজার

• “মানুষ যখন জীবন ও জীবিকার তাগিদে, বেঁচে থাকার ন্যুনতম প্র‍য়োজনগুলো মেটাতেই  হিমশিম খাচ্ছে, ঠিক সেই সময় বীমা কোম্পানিগুলো যেন আলাদিনের চেরাগ হয়ে উঠেছে! এই ক্রান্তিকালীন সময়েও অধিকাংশ শেয়ারের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে।”        

করোনাকালে নানা বিধিনিষেধের বেড়াজালে মানুষের জীবনযাত্রাই যেন থমকে গিয়েছে। বেশিরভাগ আর্থিক প্রতিষ্ঠানই ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে তাদের কর্মীদের ছাঁটাই করছে। কিন্তু ভাবতে পারেন, এই পরিস্থিতিতেও  বীমা কোম্পানিগুলোর শেয়ারের  মূল্য আকাশচুম্বী হয়ে উঠেছে? পুঁজিবাজারে বীমা কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম দ্বিগুন, তিনগুন, এমনকি চারগুন পর্যন্ত বেড়েছে! ভাবুন তো, মহামারির এই ক্রান্তিলগ্নে এমন ব্যবসাও রয়েছে যেখানে আপনার টাকা তিনগুন-চারগুন হয়ে যাবে মাত্র আড়াই মাসে!    

বীমা কোম্পানিগুলোর শেয়ারের অসামঞ্জস্যতা

এমন খবর শুনে নিশ্চয়ই আপনার জমানো টাকাগুলো নিয়ে শেয়ার কিনতে ছুটবেন? যদি এমনটা ভেবে থাকেন, তবে থামুন। কারণ বাজার বিশ্লেষকদের মতে এভাবে মূল্যবৃদ্ধি পাওয়া একেবারেই অস্বাভাবিক।   

“পুরো বাজারেই একরকম অস্থিরতা তৈরি করে বিগত বছরগুলোতে প্রায় প্রতিটা বীমা কোম্পানির শেয়ারই অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এদের মধ্যে আবার অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ার এই অতিমারির সময়টাতে উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে যা বাজার বিশ্লেষকদের মাঝে একপ্রকার শঙ্কার সৃষ্টি করেছে।”

সাধারণ বীমা কোম্পানিগুলোর বৃদ্ধি

• ৪৮ টি বীমা কোম্পানির মধ্যে প্রায় ২৬ টি সাধারণ বীমা কোম্পানির   শেয়ারমূল্য বেড়ে তিনগুন দাঁড়িয়েছে। 

• ৩০ টির মধ্যে প্রায় ২৫ টি বীমা কোম্পানির লভ্যাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে।

• ১২ টি কোম্পানির শেয়ারের মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ৩০০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

বীমা কোম্পানিগুলোর শেয়ারের মূল্য এরকম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ

বাজার বিশ্লেষকদের মতে শেয়ারের এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পেছনে কিছু কারণ থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এর পেছনে কারসাজিকারকদের হাত রয়েছে বলে মনে করেন। শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধির কারণগুলো হলো-

১. সরকারের সাধারণ জনগনকে বীমা সুবিধার আওতায় আনার সিদ্ধান্ত যা বীমা কোম্পানিগুলোকে সকলের কাছে ইতিবাচক করে তুলেছে।

২. কোম্পানির প্রতিনিধিদের ১৫ শতাংশের উপরে লভ্যাংশ প্রদানের সিদ্ধান্ত। যদিও ২০১২ সালের দিকে কোম্পানিগুলোর উক্ত সিদ্ধান্তের উপর ইনস্যুরেন্স ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেটরি অথরিটি( IDRA) নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

৩. কিছু কোম্পানির অধিক লভ্যাংশ প্রদানের সিদ্ধান্ত যদিও তাদের শেয়ারের মূল্য নিতান্তই কম।

গত এক বছরে বীমা কোম্পানিগুলোর অবস্থান

শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব     

বীমা কোম্পানিগুলো মূলত ছোট আকারের আর্থিক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে কোম্পানিগুলোর শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধিতে বিনিয়োগকারীদের আর্থিক ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি করে দেখছেন বাজার বিশ্লেষকরা। টানা মূল্যবৃদ্ধির কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও হাতের সব টাকা দিয়ে বীমা কোম্পানিগুলোর শেয়ার কিনে নিচ্ছে। ফলে পুঁজিবাজারে অন্যান্য কোম্পানিগুলোর শেয়ারমূল্য কমে যাওয়ায়  সেসকল কোম্পানি আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।

“অধিকাংশ বীমা কোম্পানিই ব্যবসায় নিরাপত্তার অজুহাতে ৬০ শতাংশের অধিক লভ্যাংশ প্রদানে বিমাকারীদের প্রস্তাব দেয়, যা সামগ্রিকভাবে অস্থিরতাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।”     

দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী সেরা দশটি বীমা কোম্পানি

তাছাড়া বীমা কোম্পানিগুলো ছোট আকারের আর্থিক প্রতিষ্ঠান হওয়ায় কারসাজিকারকরা এই কোম্পানিগুলোকে ব্যবহার করে লভ্যাংশ হাতিয়ে নিচ্ছে। আর যেকোন সময়ে শেয়ারের অস্বাভাবিক দরপতনের সম্ভাবনা তো থাকছেই। ফলে অধিক লভ্যাংশের আশায় যারা বিনিয়োগ করেছেন তাদের আর্থিক ক্ষতির সম্ভাবনা নিতান্তই কম নয়। ফলে এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি পুরো বাজারকেই অস্থির করে তোলার  সমূহ সম্ভাবনা দেখছেন বিশ্লেষকরা।

বিশেষজ্ঞদের মতামত     

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের একজন প্রাক্তন কর্মকর্তা মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘ সাম্প্রতিক সময়ে বীমা কোম্পানিগুলোর শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি নিঃসন্দেহে বাজারকে অস্থিরতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা অন্ধের মতো বীমা খাতের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। এটা কখনোই টেকশই উন্নয়নের লক্ষমাত্রা(SDGs) হতে পারে না।’      

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ভবন

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ‘বাজার নিয়ন্ত্রক প্রতিনিধিরা শেয়ার বাজারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি কিংবা হ্রাস নিয়ে চিন্তিত নন। বরং তারা ব্যবসা ক্ষেত্রে ভুলভ্রান্তিগুলোই খুঁজে বেড়ান। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ ইতমধ্যেই বীমা কোম্পানিগুলোর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে বিএসইসির কাছে রিপোর্ট প্রদান করেছে।  তবে এই করোনাকালীন সময়ে এসব নিয়ে তদন্ত একেবারে শুরুর পর্যায়েই রয়ে গেছে।’

করিম আরও উল্লেখ করেন, ‘ আমরা সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে গুজব ছড়ানোর বিরুদ্ধে কাজ করছি। আশা করি খুব শীঘ্রই সমস্যাগুলো সমাধানের দিকে নিয়ে যেতে পারব।’    

বিনিয়োগকারী ও নীতিনির্ধারকদের করণীয়                       

যদিও বীমা কোম্পানিগুলো সরকারের বিভিন্ন বিধিনিষেধ মেনে চলতে একমত হয়েছে, তথাপি নীতিনির্ধারকদের বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে সর্বপরি এগিয়ে আসতে হবে। অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধি বা দর পতন ঠেকাতে সার্কিট ব্রেকারের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে এবং সে সাথে বীমা কোম্পানিগুলোর উপর থেকে কারসাজিকারকদের হঠাতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে। 

আর বিনিয়োগকারী হিসেবে আপনাকে আরও সচেতন হতে হবে। যেকোন বিনিয়োগের ক্ষেত্রেই আপনাকে সবকিছু জেনে নিয়ে বিনিয়োগ করতে হবে।

আলোচ্য বিষয় সম্পর্কিত আমাদের অন্য ব্লগগুলো পড়ুন।

Sm. Shahin Ahmed Nazim

Content Writing Department Intern

YSSE