টাকার কি কোনো মূল্য আছে? নাকি টাকা শুধুই কিছু সংখ্যা লিখিত আর চমৎকার কারুকার্যখচিত কাগজ? পায়ের তলার ধুলার যে দাম, টাকার দাম কি কখনো এমন হয়ে যেতে পারে? কি অবান্তর প্রশ্ন! তাই না? বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি নিয়ে চায়ের কাপগুলো আজকাল খুব গরম। টাকার মূল্য নাকি পড়ে যাচ্ছে! এই ঘটনা সবাই বাজারে গেলেই বুঝতে পারছেন। কিন্তু, টাকার মূল্য কমে যায় কীভাবে? এই প্রশ্নের উত্তর কতজন দিতে পারবেন? প্রতিবছরই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে দেউলিয়া হওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে কেন? সুদের ব্যবসা এবং সাধারণ পন্য বা সেবার ব্যবসার ভেতর কোনো পার্থক্য আছে কি? খালি চোখে দুইটিকেই তো টাকা উপার্জনের উৎস বলে মনে হয়। সুদ বা মুনাফা বা Interest যাই বলি, তা একটি সমাজের জন্য সুবিধাজনক নাকি অসুবিধাজনক? ব্যাংক আমাদের অর্থ বা সম্পদের নিরাপত্তা দেয় নাকি নিরাপত্তা ছিনিয়ে নেয়?
অনেকগুলো প্রশ্ন করা হয়ে গেল, তাই না? কিছু কিছু প্রশ্ন নিয়ে হয়তো কেউ কখনো চিন্তাটুকুও করবে না। হাস্যকরও লাগতে পারে। শেষ প্রশ্নটি অনেকটা সেরকমই। তবে এই সব প্রশ্নের উত্তর জানা আমাদের জন্য একপ্রকার অত্যাবশ্যকীয়। উপরের প্রত্যেকটি প্রশ্নের সাথে আপনার জীবন কোনো না কোনোভাবে সম্পর্কিত। আপনি হয়তো ভাবতে পারেন, ”আমার সাথে ব্যাংকের কী এমন সম্পর্ক? আমি না ব্যাংকে টাকা রাখি আর না ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা তুলি।” জনাব, শুধু আপনি নয় বরং আপনার কাছের সকলেই ব্যাংক কর্তৃক ছাপানো টাকা ব্যবহার করছেন। আগামীকাল ব্যাংক আপনার হাতে থাকা টাকাগুলো অচল ঘোষণা করলে আপনি পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পাবেন না। এমন কিছু যদি ঘটে, সম্ভবতো হাতে থাকা টাকাগুলো নিয়ে ব্যাংকেই দৌঁড়াবেন। সুতরাং, হলফ করে বলা যায়, এই যুগে এসে আপনি সহ আপনার চোখ আশেপাশে যাদের দেখছে, সকলের সাথেই ব্যাংকের কোনো না কোনো সম্পর্ক রয়েছে। হোক তা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ। কারণ, সকলেই বিনিময়ের জন্য কাগজের টাকাকেই ’একমাত্র’ মাধ্যম হিসেবে ’মেনে’ নিয়েছে। তাই আপনার সাথে ব্যাংকের কোনো সম্পর্ক নেই, এমন অবাস্তব ধারণা থেকে বেরিয়ে আসুন।
উপরের আলোচনায় ’সুদ’ বলে একটি শব্দ এসেছে। হয়তো ব্যক্তিগতভাবে আপনি এটিকে ঘৃণা করেন। মুসলমান হলে হয়তো ধর্ম রক্ষার খাতিরেই সুদ থেকে যথাসম্ভব বেঁচে থাকার চেষ্টা করেন। খুব সম্ভবতো এটা ভেবে পুলকিত হচ্ছেন, জীবনে কখনোও সুদের ধারেকাছেও আপনি পা মাড়াননি; না সুদ দিয়েছেন আর না নিয়েছেন। কিন্তু আমি যদি বলি, আপনিও পরোক্ষভাবে সুদের ঘানি টানছেন। এটা বিশ্বাস হবে? হবে না হয়তো (অবশ্য আমতা আমতা হালকা বিশ্বাস আসলেও আসতে পারে)। কারণ, বিশ্বাস করানোর মতো কোনো কিছুই আমি এখানে উপস্থাপন করিনি।

ভেদ্য তবু ’অভেদ্য’ : ব্যাংকব্যবস্থা ও টাকার গোপন রহস্য
ছবি: মোহাইমিন পাটোয়ারী
আমার দাবি সত্য কি না, তা জানতে হলে এবং আপনার জীবনের অর্থনৈতিক টানাপোড়েন ও সমাজের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্যকে হৃদয়ঙ্গম করতে হলে আপনাকে উপরের প্রশ্নগুলোর উত্তর জানতে হবে। যার জন্য আপনাকে পড়তে হবে অর্থনীতি বিষয়ক গবেষক ও তরুণ লেখক মোহাইমিন পাটোয়ারী লিখিত ‘ব্যাংকব্যবস্থা ও টাকার গোপন রহস্য’ বইটি। এই বইয়ের মাধ্যমে লেখক অর্থনীতি বিষয়ক ধারণাগুলো কী চমৎকার ও সরল ভঙ্গিমাতেই না আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন! এতটাই সরল ও প্রাঞ্জল যে, অর্থনীতি নিয়ে ধারণা না থাকা ব্যাক্তিটিও এই বইটি বুঝতে পারবে যদি প্রাথমিকের গণিত বুঝতে তার কোনো সমস্যা না থাকে।
প্রথমে লেখক গল্পের ছলে আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন প্রাচীন অর্থনীতির ’বিনিময় প্রথা’কে। এরপর ধীরে ধীরে তিনি মুুদ্রাব্যবস্থা, সুদ, ব্যাংকব্যবস্থা, টাকা, ফিয়াট মানি, মূল্যস্ফীতি, দেউলিয়াত্ব, বেইল আউট ও তারল্য সংকটের মতো অর্থনীতির বাঘা বাঘা জটিল বিষয়গুলো সেই গল্পের আঙ্গিকেই আমাদের সামনে সরল ভঙ্গিমায় তুলে ধরেছেন। এতে আস্তে আস্তে বইয়ে গল্পের কলেবর বেড়েছে। কিন্তু, যিনি পাঠক, তিনি গল্প পড়তে পড়তে এরই মাঝে বুঝে গেছেন এতদিনের বাকপ্রতিবন্ধী অর্থনীতি আদতে কথা বলতে জানে। হটাৎ করেই এতদিনের দুর্বোধ্য অর্থনীতি যেন হয়ে উঠলো সহজপাচ্য ও সহজবোধ্য।

ভেদ্য তবু ’অভেদ্য’ : ব্যাংকব্যবস্থা ও টাকার গোপন রহস্য
ব্যাংকের সিন্ধুকে কী থাকে, আপনি জানেন কি?
সুদ নিয়ে সাধারণত আমরা ধর্মীয় বক্তাদের উপদেশ শুনে থাকি। অনেকে হয়তো শুনতে শুনতে ক্লান্তি বোধ করে থাকতে পারেন। তাদের জ্ঞাতার্থে জানাতে হয়, মোহাইমিন পাটোয়ারি কোনো ধর্মীয় বক্তা বা লেখক নন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে পড়ালেখা শেষ করে ইউরোপের দুইটি বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থনীতি বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছেন। এই বইয়ে তিনি ধর্ম বিষয়ক কোনো কিছুই উল্লেখ করেননি। সম্পূর্ণ দুনিয়াবি দৃষ্টিকোণ থেকেই তিনি অর্থনীতি, সুদ, ব্যাংকব্যবস্থা ও টাকার গোপন রহস্যগুলোর জট খোলার চেষ্টা করেছেন। তিনি তার দাবিগুলোর দৃঢ়তা দিতে পৃথিবীর বিভিন্ন রথী মহারথীর কালজয়ী উক্তির আশ্রয় নিয়েছেন, যাদের সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্কই নেই।
এই বইয়ের ভেতরে থাকা উক্তিগুলোই আমার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় বলে মনে হয়েছে। কারণ, উক্তিগুলো এমনভাবে জুড়ে দেওয়া হয়েছে যে, সেগুলোর ঠিক আগের আলোচ্য বিষয়টি জুড়ে দেওয়া উক্তিগুলোর মাধ্যমে পরিষ্কার থেকে পরিষ্কারতর হয়েছে। লেখক যেই উক্তির মাধ্যমে তাঁর লেখা শুরু করেছেন, আমিও সেটিকে এখানে তুলে দেওয়া বাঞ্চনীয় বলে মনে করছি।
“এটা স্বস্তিকর যে, দেশের জনগণ ব্যাংকিং এবং মুদ্রাব্যবস্থার রহস্য সম্পর্কে অজ্ঞ। তারা যদি বিষয়গুলো জানতো, আগামীকাল রাত পোহাবার আগেই গণবিপ্লব শুরু হয়ে যেত।”
হেনরি ফোর্ড — ফোর্ড মোটর কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা।
এরকম প্রায় ত্রিশ বা পয়ত্রিশটি উক্তি আপনি এই বইয়ের ভেতর পাবেন। তার সাথে পাবেন আরও কিছু ধারণা পরিষ্কারকারী টিকা এবং নিজের চিন্তাকে শাণিত করার মতো কিছু টোটকা।
বইয়ের মন্দ দিক বলতে আসলে তেমন কিছুই চোখে পড়েনি। বইয়ের মানের কাছে প্রচ্ছদটি একটু সাদামাটা মনে হয়েছে। তবে খুব খারাপ হয়েছে, এমনটা বলা যাবে না। মাঝে মাঝে গল্পের আদলে অর্থনীতি বুঝতে গিয়ে অনেকগুলো চরিত্রের নাম মনে রাখতে একটু সমস্যা হয়েছে। যদিও সে সমস্যা কয়েক পৃ্ষ্ঠা পিছনে ফিরেই মিটিয়ে ফেলা যায়। তা ছাড়া চিন্তার টোটকার মাধ্যমে আমাদের চিন্তা করার দক্ষতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে লেখকের প্রয়াসকে সাধুবাদ জানাতে হয়। কিন্তু, আমার মন ওই বিষয়গুলোতে লেখকের চিন্তা-ভাবনা ও সমাধানগুলো কেমন হতে পারতো, তা খুঁজে ফিরেছে। আশা করছি লেখক নতুন সংস্করণে এগুলো চিহ্নিত করে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
বইটি প্রকাশিত হয়েছে ’ঐতিহ্য’ প্রকাশনী থেকে। বইয়ের পৃষ্ঠা সংখ্যা প্রায় ১৬০টি। পৃষ্ঠাগুলো যথেষ্ট মানসম্পন্ন। তা ছাড়া আমার চোখ আরামের সাথেই বইয়ের লেখাগুলো পড়তে পেরেছে। মুদ্রিত মূল্য রাখা হয়েছে ৩০০ টাকা। সাধারণ লাইব্রেরি থেকে ২২৫ টাকাতে পাওয়া যাচ্ছে (খুব সম্ভবতো)। অনলাইনে রকমারি এবং ওয়াফীলাইফ-এ পাওয়া যাচ্ছে।
নিজে কিনে পড়ুন কিংবা বন্ধু বা অন্য কারও কাছ থেকে ধার করে পড়ুন, যেভাবেই হোক বইটি পড়ুন। এই বইটি না পড়লে কিংবা বইয়ে যা আছে তা অন্য কোনো উপায়ে না জানলে আপনি জীবনের এমন অনেক বিষয় থেকে অজ্ঞ থাকবেন, যেগুলোর কারণে আপনি যুগ যুগ ধরে ভুগে আসছেন। বিষয়গুলো জানলে হয়তো সামনে এমন দিন আসতে পারে, যেদিন আপনি আপনার ভোগান্তির একটা সমাধান করে ফেলবেন।
এই বই নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট বক্সে পোস্ট করে জানিয়ে দিন আপনার প্রশ্নটি।
আমাদের আরও ব্লগ পড়তে ক্লিক করুন এখানে।
Writer
Md. Tangidul Hasan
Intern, Content Writing Department
YSSE