মার্কেটিং এর হাজার কৌশলের ভিড়ে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং একদম ভিন্ন। তবে অসংখ্য ধোঁকাবাজি ও বিতর্কিত ঘটনায় আশেপাশের পরিবেশ সয়লাব হয়ে যাওয়ায় অনেকেই আর এই প্রক্রিয়ার উপর আস্থা রাখা নিয়ে সন্দিহান বটে! তবে মাল্টি – লেভেল মার্কেটিং কি আসলেই তাই?
যদি আপনি একটি এমএলএম বা মাল্টি – লেভেল মার্কেটিং প্রোগ্রামে যোগদান করেন, কোম্পানি আপনাকে একটি স্বাধীন “পরিবেশক” বা “অংশগ্রহণকারী” হিসাবে উল্লেখ করতে পারে।
বেশিরভাগ এমএলএম বলে যে আপনি দুটি উপায়ে অর্থ উপার্জন করতে পারেন:
- এমএলএম -এর পণ্যগুলি “খুচরা” বা রিটেইল গ্রাহকদের(যারা এমএলএম -এর সাথে জড়িত নয়) কাছে বিক্রি করে অর্থ আয় করা যায়।
- নতুন ডিস্ট্রিবিউটর নিয়োগ করে এবং খুচরা গ্রাহকদের কাছ থেকে (তারা কি কিনে এবং তাদের বিক্রির উপর ভিত্তি করে) তার উপর কমিশন আয় করা যায়।
আমার এবং আমার কর্তৃক নিয়োগকৃত মানুষের দ্বারা নিয়োগপ্রাপ্ত মানুষজন মিলে একটি বড় বিক্রয় নেটওয়ার্ক বা “ডাউনলাইন” তৈরি হয়ে যায়।মাল্টি-লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) হল একটি মার্কেটিং কৌশল যেখানে সেলস ফোর্সগুলো শুধুমাত্র ব্যক্তিগতভাবে উৎপাদিত পণ্য বিক্রির জন্য ক্ষতিপূরণ দেয় না, বরং নিয়োগকৃত বিক্রয়কর্মীর বিক্রির উপরও তা নির্ধারিত হয়।
#এমএলএমগুলি কী এবং তারা কীভাবে কাজ করে?
এমএলএম কোম্পানিগুলো ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির মাধ্যমে তাদের পণ্য বা সেবা বিক্রি করে। অর্থাৎ, আপনি সরাসরি অন্যদের কাছে আপনার বাড়ি বা গ্রাহকের বাড়ি অথবা অনলাইনে কম পণ্য বিক্রি করছেন। কিছু বিষয় মাথায় রাখা প্রয়োজন –
- এমএলএম ব্যবসায় থাকার সময়কাল
- বিনিয়োগের পর এক বছরে প্রাপ্ত আয়
- বিনিয়োগের হিসাব অনুযায়ী প্রাপ্ত লাভ
- টাকা আয় করার জন্য কোনো কর্মী নিয়োগ প্রয়োজন কিনা।
- নিয়োগকৃত মানুষ সংখ্যা এবং সেই অনুসারে প্রাপ্ত সুযোগ কতটুকু।
- এমএলএম- এর বাইরের গ্রাহকদের কাছে পণ্য বিক্রির শতাংশ
- পরিবেশকদের নিয়োগ এবং আইটেম বিক্রি শুরু করার জন্য আর্থিক উপার্জনের শতাংশ
- এমএলএম থেকে কেনা ও বিক্রি করা ইনভেন্টরি।
এ বিষয়গুলো মাথায় রাখলে পর্যালোচনা করা সহজ হয়ে ওঠে।
#একটি পিরামিড স্কিম কী এবং আপনি কীভাবে এটি চিহ্নিত করবেন?
অতিরঞ্জিত তথ্য প্রদান কিংবা “অলৌকিক” বা “জাদুকরী” জাতীয় শব্দের ব্যবহার করে সুবিধা হাতিয়ে নিতে চাওয়া কোম্পানিগুলো নিয়ে সচেষ্ট থাকা প্রয়োজন। অসদুপায় অবলম্বন করে টাকা হাতিয়ে নেয়ার এমএলএমের সনাতন পদ্ধতিকে পিরামিড স্কিম বলে। পিরামিড স্কিমগুলি রীতিমতো নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে! এগুলো বৈধ এমএলএম ব্যবসার সুযোগের মতো মনে হতে পারে। কিন্তু আপনি যদি পিরামিড স্কিমের পরিবেশক হয়ে থাকেন, তবে প্রায়শই নিয়োগকৃত টাকার ফেরতপ্রাপ্তি আপনার জন্য অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে। বাংলাদেশেও একটা সময় বেনামে মানি অর্ডার আসার হিড়িক পরে গিয়েছিল এবং অনেকেই সেই ফাঁদে পরেছিল।
ইউএস ফেডারেল ট্রেড কমিশন (এফটিসি) বলেছে: “নতুন পরিবেশকদের নিয়োগের জন্য কমিশন প্রদানে এমএলএম (বহু স্তরের বিপণন পরিকল্পনা) থেকে দূরে থাকুন। এগুলি আসলে অবৈধ পিরামিড স্কিম। কারণ যখন কোনো নতুন পরিবেশক নিয়োগ করা যায় না, তখন নতুন পরিবেশকদের নিয়োগের জন্য কমিশন প্রদানের পরিকল্পনাও অনিবার্যভাবে ভেঙে যায়। “পিরামিড স্কীম কিছুদিন চলার পর স্বাভাবিক নিয়মেই তা বন্ধ হয়ে যায়। যখন মানুষ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করে, তখন পিরামিড স্কীম আইন করে বন্ধ করে দেওয়া হয়। আমেরিকাতে ছাড়া আরও কিছু দেশে আইন করে তা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
#বৈশ্বিক পরিস্থিতি
মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এম এল এম) প্রথম ১৯৪৫ সালে আমেরিকায় শুরু হয়। পরবর্তীতে তারা এই ব্যবসা থেকে সরে আসলেও অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে এই ব্যবসার প্রকোপ লক্ষ্য করা যায়। এই ব্যবসাটা মূলত মার্কেটিং বা পণ্য বিপণনের উপর ভিত্তি করে গড়ে তোলা।
টপারওয়্যার পার্টি এবং এ্যাভন কনসালটেন্টস হলো মাল্টি লেভেল মার্কেটিং এর সাধারণ উদাহরণ যা অধিকাংশ মানুষের কাছে পরিচিতি পেয়েছে। ঐতিহ্যবাহী পণ্য বিক্রির বিপরীতে (যেখানে বিক্রয় প্রতিনিধিরা একটি কোম্পানি দ্বারা নিযুক্ত হয়), মাল্টি-লেভেল মার্কেটিং মডেল ফ্রিল্যান্স ডিস্ট্রিবিউটর ব্যবহার করে সম্পূর্ণ বা খণ্ডকালীন কাজগুলো সম্পন্ন করে।
এএআরপি ফাউন্ডেশন দেখেছে যে, প্রায় ২৫% মানুষ এমএলএম দিয়ে লাভ করলেও, ২৭% তাদের টাকা হারিয়েছে। যে প্রান্তিক মুনাফা হয়েছে তন্মধ্যে ১৪% সংস্থা ৫,০০০ ডলারের কম এবং ৬% ৫,০০০ এবং ৯,৯৯৯ ডলারের মধ্যে তৈরি করেছে।
#বাংলাদেশে মাল্টি-লেভেল মার্কেটিং
২০১৪ সালে বাংলাদেশ সরকার চারটি মাল্টি লেভেল মার্কেটিং এর কোম্পানিকে দেশে ব্যবসা করার অনুমতি দিয়েছিল। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, লাইসেন্সগুলি ইস্যু করা হয়েছিল ৫ মার্চ। কোম্পানিগুলো হলো স্বাধীন অনলাইন পাবলিক লিমিটেড, ওয়ার্ল্ড মিশন ২১ লিমিটেড, রিচ বিজনেস সিস্টেম লিমিটেড এবং এমএক্সএন মডার্ন হারবাল ফুড লিমিটেড। মোট ২১ টি প্রতিষ্ঠান লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছিল। রিচ বিজনেস সিস্টেম লিমিটেডের ওয়েবসাইটে আপলোড করা লাইসেন্স ডকুমেন্ট অনুযায়ী কোম্পানিগুলো ওয়েবে তাদের উপস্থিতি দেখিয়েছিল।
বিতর্কিত ডেসটিনি কোম্পানি লাইসেন্সের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রনালয়ে আবেদন করেছে। তবে কিছু এমএলএম অবৈধ পিরামিড স্কিম হতে পারে বিধায় সতর্ক থাকতে হয়।
#সফল এমএলএমের দ্বারস্থ হবার জন্য যা মাথায় রাখতে হবে-
- সম্পূর্ণ অর্থ ফেরত পেতে কতক্ষণ লাগতে পারে তা বিবেচনা করা।
- কাগজপত্র পড়া এবং একজন বন্ধু বা উপদেষ্টা সাথে সে সম্পর্কে পর্যালোচনা করা।
- কোম্পানির বিক্রয় সাহিত্য, ব্যবসায়িক পরিকল্পনা, প্রকাশের নথি, এবং যে কোন চুক্তি বা চুক্তি আপনাকে সাইন করতে হবে তা পড়া প্রয়োজন।
- একজন হিসাবরক্ষক, একজন আইনজীবী বা আপনার বিশ্বাস করা কাউকে (যিনি কোম্পানির সাথে যুক্ত নন), আপনাকে এমএলএমের উপকরণগুলি পর্যালোচনা করতে সহায়তা করার কথা বলা যেতে পারে। তাদেরকে আপনার সম্ভাব্য উপার্জন এবং কোম্পানিটি আপনার দাবির ব্যাকআপ রাখতে পারে কিনা তা দেখতে বলা।
- এমএলএম বৈধ এবং আপনার জন্য উপযুক্ত বলে মনে করেন কিনা সে বিষয়ে তাদের সৎ মতামত জিজ্ঞাসা করা।
- বর্তমান এবং অতীত পরিবেশকদের সাথে এমএলএমে তাদের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে কথা বলা।
- কঠিন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা এবং বিস্তারিত জানার জন্য তথ্য খোঁজ করা।
- ফেরত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা প্রয়োজন। অনেক এমএলএমে পণ্য বিক্রি শুরু করার আগে, আপনাকে সেগুলি কোম্পানির কাছ থেকে কিনতে হয়। সুতরাং কোম্পানির রিফান্ড নীতি লিখিতভাবে থাকতে হবে। এতে বিধিনিষেধ এবং জরিমানার সাথে কোন অব্যবহৃত পণ্য ফেরত দেওয়ার তথ্য রয়েছে কিনা সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।
- অনেক এমএলএম আপনাকে প্রশিক্ষণ বা বিপণন সামগ্রী কিনতে অর্থ প্রদান করতে বাধ্য করে। এজন্য আপনাকে যেকোনো কাজের পূর্বে যেমন ভ্রমণের জন্য বা হোটেল বুক করতে হলে খরচ প্রক্রিয়া পুরোপুরি জানতে হবে।
মাল্টি-লেভেল মার্কেটিং পদ্ধতিটি বাংলাদেশে সর্বস্তরের মানুষের কাছে ক্রমাগত জনপ্রিয়তা পেয়েছে। নেটওয়ার্ক মার্কেটিং বা এমএলএম পদ্ধতি প্রয়োগে বেকারপীড়িত এদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ আত্ম-কর্মসংস্থানের পথ পেয়েছে। যৎসামান্য পুঁজি বিনিয়োগে বা পণ্য বিপণনের মাধ্যমে নিজেদেরকে স্বাবলম্বী হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস করেছে। অতি উচ্চ শিক্ষা বা পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই ছাত্র-ছাত্রী, স্বল্প আয়ের চাকুরিজীবী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, সমাজসেবী, রাজনীতিবিদ, এমনকি যে কোন পেশার মানুষকে এ পদ্ধতি এনে দেয় আর্থিক স্বচ্ছলতা। এজন্য বিশ্বের বহু দেশে এই বিপণন পদ্ধতিটি “Freedom Enterprise” হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
তাই, এমএলএম যদি পিরামিড স্ক্যাম না হয়ে থাকে, তবে নতুন বিনিয়োগকারী নিয়োগ না করেই গ্রাহকের কাছে বিক্রি করা পণ্যের উপর সহজেই অর্থ প্রাপ্তি সম্ভব। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, আপনি একটি সম্ভাব্য ব্যবসায়িক চুক্তি চেক করার মিশনে আছেন যার জন্য আপনার সময় এবং অর্থের প্রয়োজন হবে। এখান থেকে শেখা তথ্য আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে ও চুক্তির সত্যতা বুঝতে সাহায্য করতে পারে, ধোঁকা বা সরাসরি অবৈধ বিষয়গুলো এড়িয়ে প্রকৃত এমএলএম মার্কেটিং এর আওতায় সকলকে আনার প্রয়াস থাকা আবশ্যক।
আমাদের আরো ব্লগ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
Writer
Nusanta Samayel Audri
Content Writing Intern
YSSE