এই সিরিজের গত পর্বে আমরা জেনেছি, বান্দরবান এবং রাঙামাটি জেলার চমৎকার মনোমুগ্ধকর কয়েকটি শান্তিময় ভ্রমণ স্থান সম্পর্কে। আর আজকের পর্বে আমরা জানবো, সিলেট এবং কক্সবাজার জেলার অত্যন্ত মুগ্ধতায় ভরপুর কয়েকটি স্থানসমূহ। যা আপনার অশান্ত মনে শান্তির বন্যা বইয়ে দিবে। তাহলে চলুন আজ আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেই এমনি কিছু শান্তিপূর্ণ ভ্রমণ স্থানসমূহের সাথে যা সৌন্দর্যে আপনারা মুগ্ধ হতে বাধ্য।
সিলেট
“সিলেট” প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে ঘেরা একটি শহর। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বে হযরত শাহজালাল ও শাহপরাণের অবিস্মরণীয় নদীর তীরে অবস্থিত সিলেট। ঢাকা থেকে এর দূরত্ব বর্তমানে প্রায় ২২৬ কিলোমিটার। বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান পর্যটন স্থান হচ্ছে সিলেট। প্রকৃতির এমন কোনো রূপ নেই যা সিলেটে অনুপস্থিত। সবুজে ঘেরা চা বাগান, অসংখ্য পাহাড়, অসম্ভব সুন্দর নদী এবং মনোমুগ্ধকর ঝর্ণার সমন্বয়ে সৃষ্টিকর্তার এক অপরূপ সৃষ্টি সিলেট। এই কারণেই প্রকৃতিপ্রেমীরা তাদের ব্যস্ত জীবন থেকে সময় পেলেই ছুটে আসে সিলেটে। চলুন জেনে নেই সিলেটের এমন ৬টি শান্তিময় স্থান সম্পর্কে যার মনোমুগ্ধকর রূপ আপনার মনে গেঁথে যাবে।
- সবুজে ঘেরা “চা-বাগান”
সিলেটের নাম শুনলেই সবার প্রথমেই যেন চোখের সামনে সিলেটের চা-বাগান ভেসে উঠে। সিলেটে গিয়েছে অথচ চা-বাগানে দেখেনি এমন অনেক কম মানুষই আছেন। সিলেটের অসংখ্য চা-বাগানের মধ্যে মালনীছড়া ও লাক্কাতুরা চা-বাগানের সৌন্দর্য অসাধারণ। যা সিলেট শহর থেকে বিমানবন্দর যাওয়ার পথেই আবস্থিত। এই দুই চা-বাগানে রয়েছে রয়েছে এক অপরূপ মনোমুগ্ধকর শান্তি। যা বলে বোঝানো সম্ভব না বিশেষ করে চা-প্রেমীদের জন্য।
- পাথরের বিছানা “বিছানাকান্দি”
সিলেটের অত্যন্ত জনপ্রিয় স্থান হচ্ছে বিছানাকান্দি। সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলার রুস্তমপুর ইউনিয়নের সীমান্ত ঘেঁষে বিছানাকান্দি অবস্থিত। বিছানাকান্দির চারপাশ পাথর বিছানো। মাটি কম পাথর বেশি দেখা যায়। তাই এই জায়গাটিকে অনেকে পাথরের বিছানা বলে থাকেন। বিছানাকান্দির পাশেই রয়েছে পান্থুমাই ঝর্ণা। বিছানাকান্দি যেন অসংখ্য পাথর বিছানো বিস্তীর্ণ প্রান্তরের উপরে বয়ে চলা মেঘালয়ের পাহাড়ী ঝর্ণাধারার এক অপরূপ মনোমুগ্ধকর ভ্রমণ স্থান। যার সৌন্দর্যে আপনি মুগ্ধ না হয়ে খাকতেই পারবেন না।
- প্রকৃতির কন্যা “জাফলং”
সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলার পিয়াইন নদীর তীরে ভারতের মেঘালয় সীমান্ত ঘেঁষে অবস্থিত জাফলং। একসময় সবার কাছে সিলেট বলতেই ছিল জাফলং।জাফলংয়ের চমৎকার সৌন্দর্যের জন্য এটি প্রকৃতির কন্যা হিসেবে পরিচিত। কিছুটা দূরে তাকালেই দেখা যায় ডাউকি ব্রিজ। জাফলং থেকে ২০মিনিটের দূরত্বেই ভারতীয় সীমান্তে রয়েছে অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণা। পাথরের মাঝে বয়ে চলা হিমশীতল পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ পানির ধারা, অপরূপ ঝুলন্ত ডাউকি ব্রীজ, সবুজে ঘেরা উচুঁ উচুঁ পাহাড়ের মাঝে সাদা মেঘের ছড়াছড়ি, চোখ বন্ধ করলেই কানে আসা সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণার শব্দ; এসব কিছুর মধ্যেই রয়েছে এক অপরূপ মনোমুগ্ধকর শান্তি।
- সিলেটের সুন্দরবন “রাতারগুল সোয়াম্প ফোরেস্ট”
রাতারগুল সোয়াম্প ফোরেস্ট হচ্ছে বাংলাদেশের একমাত্র সোয়াম্প ফোরেস্ট বা জলারবন। এটি সিলেটের শহর থেকে প্রায় ২৬ কিলোমিটার দূরে গোয়াইনঘাট উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নে অবস্থিত। এর পুরো বন জুরে রয়েছে পানি এবং অসংখ্য গাছ। গাছ এবং জলাশয়ের সমন্বয়ে অপরূপ সৌন্দর্যের এই রাতার সোয়াম্প ফোরেস্টটি অনেকের কাছে সিলেটের সুন্দরবন নামে পরিচিত। এমনকি অনেক পর্যটকরা তো রাতারগুলকে বাংলাদেশের আমাজন হিসেবেও অভিহিত করেছেন। গাছগুলো হাটু অবধি বছরের ৭/৮ মাস পানিতে নিমজ্জিত থাকে। নৌকাতে ঘুরতে হয় বনের চারপাশ। অত্যন্ত শান্ত ও কোনাহলমুক্ত স্থান এই জলারবনটি। এছাড়াও এখানে রয়েছে চমৎকার ওয়াচটাওয়ার এবং শীতকালে রয়েছে হাজারো অতিথি পাখির মেলা। রাতারগুলের সৌন্দর্য ও অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর পরিবেশ আপনার মনে এক অন্যরকম প্রশান্তি অনুভব করাবে।
- সিলেটের সবুজনদ “লালখাল”
সিলেট শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে জৈন্তাপুর উপজেলায় লালখাল অবস্থিত। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিরাতের স্থান হচ্ছে এই লালখাল। ভারতের চেরাপুঞ্জি থেকে বয়ে আসা পুরোটা খাল জুরে রয়েছে সবুজ রঙের পানি। পানি এমন অপরূপ সবুজাভ রঙ নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবেন না। বৃষ্টি না হলে এই রঙ অপরিবর্তিত থাকে। এ যেনো সবুজে ঘেরা প্রকৃতিক মাঝে সবুজনদের এক চমৎকার সংমিশ্রিত রূপ। প্রকৃতির এই রূপ যে কতটা শান্তিপূর্ণ ও মনোমুগ্ধকর এটি শুধু তারাই বুঝতে পারবে যারা নিজে তা অনুভব করেছে।
- শাপলার রাজ্য “ডিবির হাওর”
সিলেট শহর থেকে প্রায় ৪২ কিলোমিটার দূরে জৈন্তাপুর উপজেলায় বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত ঘেঁষা পাহাড়ের পাদদেশে ডিবির হাওর অবস্থিত। মূলত ইয়াম, ডিবি, হরফকাটা, কেন্দ্রী নামক এই চারটি বিল নিয়ে এই ডিবির হাওর। বর্ষায় বিল জুরে ফুটে উঠে অজস্র লাল শাপলা। আর শীতকালে পুরো হাওর জুড়ে অতিথি পাখিদের রাজত্ব শুরু হয়। এই শাপলার রাজত্বে অতিবাহিত একটি সকাল আপনার সারাজীবন মনে থাকবে। প্রকৃতি যেন লাল শাপলার হাসিতে এই বিলগুলো পরম মমতায় সাজিয়েছে। অজস্র ফুটন্ত লাল শাপলার মাঝে চারপাশের অসম্ভব সুন্দর শান্ত পরিবেশে নৌকায় খোলা আকাশের নিচে ভ্রমণ- এ যেনো এক স্বর্গীয় অনুভুতি।
সিলেটের অপরূপ সৌন্দর্যের এই স্থানগুলো ভ্রমণের জন্য সবথেকে উপযুক্ত সময় হলো বর্ষাকাল। লালখাল ছাড়া বাকি স্থানগুলোর আসল মনোমুগ্ধকর ও চোখ জুড়ানো সৌন্দর্য শুধু বর্ষাকালেই দেখতে ও অনুভব করতে পারবেন।
কক্সবাজার
“কক্সবাজার“ এই নামটি শুনতেই যেন সমুদ্র সৈকতের কথা মনে পড়ে যায়। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে চট্টগ্রাম বিভাগে কক্সবাজার অবস্থিত। ঢাকা থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৪১৪ কিলোমিটার। বাংলাদশের সবচেয়ে বড় পর্যটন কেন্দ্র হচ্ছে কক্সবাজার। কেননা এখানে রয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত। সাথে রয়েছে বাংলাদেশের বৃহত্তম সামুদ্রিক মৎস্য বন্দর এবং সাবমেরিন কেবল ল্যান্ডিং স্টেশন।কক্সবাজার তার নৈসর্গিক সৌন্দর্যের ও মেরিন ড্রাইভের জন্য বিখ্যাত। একসময় ছিল যখন ভ্রমণপিপাসু এবং সমুদ্রপ্রেমীরা তাদের মানসিক ও শারীরিক শান্তির জন্য ছুটে যেত কক্সবাজারের সমুদ্রে সৈকতে। কিন্তু বর্তমানে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত এবং অন্যান্য বিচের যা অবস্থা তা দেখে এগুলোরে শান্তিপূর্ণ স্থান বললে ভুল হবে। তবে এছাড়াও কক্সবাজারের কয়েকটি এমন স্থানও আছে যার মনোমুগ্ধর সৌন্দর্য দেখে আপনার চোখ জুড়িয়ে যাবে। চলুন জেনে নেই কক্সবাজারের এমনি ৪টি শান্তিময় ভ্রমণ স্থানসমূহ যা আপনাকে স্বর্গীয় অনুভুতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিবে।
- দক্ষিণের স্বর্গ “সেন্টমার্টিন”
সেন্টমার্টিন বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ যা কক্সবাজার জেলায় টেকনাফ উপজেলার সর্ব-দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের মাঝে অবস্থিত। কক্সবাজার জেলা শহর থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূরে ১৭ বর্গ কিলোমিটারের একটি ক্ষুদ্র দ্বীপ সেন্টমার্টিন। স্থানীয়রা একে নারিকেল জিঞ্জিরা বলেও ডেকে থাকেন। একসময় দারুচিনি দ্বীপ নামেও পরিচিত ছিল। সেন্টমার্টিনের প্রশান্তিময় ও মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্যের কোনো তুলনা হয় না। অসীম নীল আকাশের সাথে সমুদ্রের নীল জলরাশির মিলন মেলা, সৈকত জুড়ে প্রবাল পাথরের মেলা, সারি সারি নারিকেল গাছ, কেয়াবাগান, ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে চলা গাঙচিল; প্রকৃতির অপরূপ এই সৌন্দর্যে ও মায়াময় স্নিগ্ধতায় মন জুড়িয়ে যায় নিমিষেই।
- লেবুগাছে ছড়াছড়ি “লেবুছড়ি ঝর্ণা”
কক্সবাজার ও বান্দরবানের মাঝে অবস্থিত এই লেবুছড়ি ঝর্ণা। এটি বান্দরবান জেলায় পড়লেও কক্সবাজারের মরিচ্যা স্টেশন থেকে পাতারাড়ি রোড দিয়ে অনেক কাছে। তাই এই লেবুছড়ি ঝর্ণাকে অনেকেই কক্সবাজারের অন্তর্ভুক্তই বলে থাকেন। চারপাশে অসংখ্য লেবু গাছের মাঝে পাহাড় ঘেঁষে অসম্ভব সুন্দর এই ঝর্ণাটি পাহাড়ি সৌন্দর্যের যেন এক অপরূপ লীলাভুমি। কোলামুক্ত পরিবেশে চোখ বন্ধ করে শুনলেই কানে আসে ঝর্ণার মধুর ধ্বনি, সাথে ঝর্ণার এই হিমশীতল পানির স্পর্শ আপনাকে শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তির সাথে পরিচয় করিয়ে দিবে।
- পাহাড়ের কোল ঘেঁষে “হিমছড়ি”
সাধারণত কক্সবাজারে গিয়েছে অথচ হিমছড়িতে যায়নি এমন কাউকেই হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। কক্সবাজার শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরেই অবস্থিত হিমছড়ি। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে এই হিমছড়ি সমুদ্র সৈকত সাথে রয়েছে আকর্ষণীয় হিমশীতল ঝর্ণা। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত থেকে হিমছড়ি সমুদ্র সৈকত অপেক্ষাকৃত বেশি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও নির্জন। পাহাড়ে উঠলেই চোখের সামনে ভাসবে নীল দিগন্তে হারিয়ে যাওয়া বিশাল সমুদ্র সাথে চারপাশে ভেসে বেড়াবে ঝর্ণার শব্দ- এ যেনো এক অপরূপ চোখ জুড়ানো ও মনে গেঁথে থাকার মতো প্রকৃতির লীলাভূমি। মনোমুগ্ধকর প্রকৃতির এই রূপ মাঝে খোলা জীপে চড়ে ভ্রমণের যে প্রশান্তিময় অনুভুতি তা বলে বোঝানো যাবে না।
- পাহাড়িয়া দ্বীপ “মহেশখালি দ্বীপ”
মহেশখালি দ্বীপ হচ্ছে বাংলাদেশের একমাত্র পাহাড়িয়া দ্বীপ। কক্সবাজার জেলা শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। মূলত মহেশখালি কক্সবাজারের একটি উপজেলা কিন্তু সকলের কাছে এটি মহেশখালি দ্বীপ নামে পরিচিত। এখানে রয়েছে আরও কয়েকটি ছোট দ্বীপ সাথে রয়েছে চারপাশ বিস্তৃত সুন্দরবনের মতো ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। মাঝেই রয়েছে নিরিবিলি একটি লম্বা ব্রিজ। খোলা নীল আকাশের নিচে বিস্তৃত ম্যানগ্রোভ বনে ঘেরা অসংখ্য ছোট বড় পাহাড়ের মাঝে প্রকৃতির অসম্ভব সুন্দর এই পাহাড়িয়া দ্বীপ সত্যি অতুলনীয়। চারপাশের এমন মনোমুগ্ধকর রূপের মাঝে লম্বা ব্রীজ দিয়ে হেঁটে চলা অত্যন্ত প্রশান্তিময়। এটা শুধু তারাই বুঝতে পারবে যারা এই অনুভুতি নিজে অনুভব করেছে।
কক্সবাজারের অসংখ্য ভ্রমণ স্থানসমূহের মধ্যে এই স্থানসমূহ মনে গেঁথে থাকার মতো। কক্সবাজীরের সমুদ্র সৈকত ও বীচগুলোর রাতের প্রকৃতিক রূপ অত্যন্ত প্রশান্তিময়।
কাজী সায়মা সিমরান
ইন্টার্ন অফ কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
ওয়াইএসএসই।
আমাদের অন্য ব্লগগুলো পড়তে এখানে ক্লিক করুন।