যতক্ষন শ্বাস ততক্ষন প্রশ্বাস ,আর যতক্ষণ শ্বাস–প্রশ্বাস চলতে থাকবে ততক্ষণে আমাদেরকে কোন না কোনভাবে অপরের সাথে পথ চলতে হবে আর এই পথ চলার ক্ষেত্রে আচরণ সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাংলায় একটি প্রবাদ আছে <ব্যবহারেই বংশের পরিচয়>। ব্যবহার শুধু বংশক্রমেই হয় এমনটা কিন্তু নয়। আমাদের চলতে–ফিরতে, উঠতে–বসতে এমনকি প্রত্যাহিক কাজকর্মে এই ব্যবহারের মাধ্যম আমাদের নিজেদের প্রকাশ পায়। উত্তম ব্যবহার আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে যতটা গুরুত্বপূর্ণ ঠিক কর্পোরেট সেক্টরে ততটাই গুরুত্বপূর্ণ। আমি আমার অধীনস্থ মানুষদের সাথে কি রকম আচরণ করছি সেটাই বয়ে নিয়ে আসবে আমার কোম্পানির সফলতা। কর্পোরেট সেক্টরে একজন লিডার কতটুকু সফল সে কতটুকু দায়িত্ববান তা প্রকাশ পায় তার অধীনস্থ মানুষের সাথে আচরণের মাধ্যমে। কর্পোরেট সেক্টরের আচরণকে আমরা সাংগঠনিক আচরণ হিসেবে ব্যাখ্যা করতে পারি।
সাংগঠনিক আচরণগুলো যেমন হওয়া দরকার:
# বিশ্বাস অর্জন করা:
যে কোনও ভালো সম্পর্কের মূল ভিত্তিই হল বিশ্বাস। আপনার প্রতি আপনার টিম বা সহকর্মীর বা তাদের প্রতি আপনার যখন পুরো মাত্রায় বিশ্বাস থাকবে – তখন যোগাযোগ ও কাজ অনেক বেশি ফলপ্রসূ হবে। আপনি যদি আপনার সহকর্মী ও বা অধীনস্থদের পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেন – তবে আপনি অনেক বেশি খোলামেলা ভাবে আপনার প্ল্যান এবং কাজ শেয়ার করতে পারবেন।
# সম্মান অর্জন করা এবং অন্যকে সম্মান করা:
সহকর্মীরা যখন আপনাকে সম্মান করবে – তখন তারা আপনার মতামত, আইডিয়া ও কাজকে গুরুত্ব দেবে। টিম ওয়ার্ক বা একক কাজ – সব ক্ষেত্রেই আপনি তাদের সহযোগীতা ও সমর্থন পাবেন। আর সম্মান পাওয়ার উপায় হল, অন্যদের সম্মান করা, তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেয়া, এবং কর্মক্ষেত্রে সব সময়ে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করা।
# নিজের ভিতর দায়িত্ববোধ জাগ্রত করা:
মানুষ দায়িত্ববান মানুষকে পছন্দ ও সম্মান করে। আপনার প্রতিটি কাজ ও কথার মাঝে দায়িত্ববোধ থাকতে হবে। সহকর্মীর সাথে কড়া আচরণের কথা না বলে ভদ্র ভাবে বলুন। আপনি যখন কর্মক্ষেত্রে এমন আচরণ করবেন, তখন অন্যরাও আপনার প্রতি দায়িত্বশীল হয়ে উঠবে।
# সবার মতামতকে গুরুত্ব দেয়া:
কর্মক্ষেত্রে যাঁরা ভালো সম্পর্ক গড়েন, তাঁরা যে অন্যের মতামতকে শুধু গুরুত্বই দেন– তা না, তাঁদের নিজের আইডিয়ার চেয়ে ভালো আইডিয়া পেলে নিজেরটার বদলে অন্যেরটা গ্রহণ করেন। এতেকরে একটি অংশগ্রহণমূলক পরিবেশ সৃষ্টি হয়, যেখানে সবাই সবার মতামত নিশ্চিন্তে জানাতে পারে। কর্মক্ষেত্রে এই ধরনের আচরণের ফলে আপনার মতামতকেও অন্যরা গুরুত্ব দেবে।
# সহকর্মীদের সাথে সঠিক তথ্য বিনিময় করা:
অফিসে বা কর্মক্ষেত্রে যে কাজটি বিরামহীন চলতে থাকে, তা হল তথ্য আদান প্রদান।এই তথ্য বিনিময় অনেকটা শরীরে রক্ত চলাচলের মত – এটা বাধাগ্রস্থ হলে পুরো প্রতিষ্ঠানেরই ক্ষতি হয়। কর্মক্ষেত্রে সবার মাঝে ভালো সম্পর্ক থাকলে, প্রয়োজনীয় তথ্য জানানোর ক্ষেত্রে কেউ দ্বিধা করে না। আপনার সহকর্মী যদি আপনাকে ভয় পায়, অথবা অপছন্দ করে – তবে সময়মত প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া আপনার জন্য কঠিন হয়ে যাবে। কাজেই, এটাই সম্ভবত কর্মক্ষেত্রে ভালো সম্পর্কের সবচেয়ে বড় উপাদান।
#নিজের যোগাযোগ দক্ষতা বাড়ানো:
সহকর্মীর সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ার জন্য আপনার যোগাযোগ দক্ষতা ভালো হওয়া খুব জরুরী। মানুষের সামনে কথা বলার সাহস ও আত্মবিশ্বাস, এবং সহজে বন্ধু বানানোর দক্ষতা আপনাকে অনেকখানি এগিয়ে দেবে। যে কোনও মানুষের সাথে কথা বলার সময়ে আন্তরিক থাকতে হবে। যখনই আপনাকে কেউ কিছু বলবে – আন্তরিকতার সাথে তার কথা শুনুন ও বুঝতে চেষ্টা করুন। দায়সারা ভাবে শুনবেন না – তাহলে কিন্তু সামনের মানুষটি বুঝে যাবে – এবং তার সাথে আপনার আন্তরিকতা নষ্ট হবে।
# অন্যের সমস্যা উপলব্ধি করা:
অফিসে সর্বদা নিজের সুবিধা দেখবেন না। আপনার কারণে অন্যরা কতটা সমস্যায় পরছে তা বোঝার চেষ্টা করুন। আমরা অনেক সময় নিজের সুবিধার জন্য অন্যদের কতটা সমস্যা সৃষ্টি হবে তা ইচ্ছে করেই না বোঝার চেষ্টা ভান করি। এমন মানসিকতা অফিসের পরিবর্তন করতে হবে।
# অন্যের উপর মাত্রাতিরিক্ত কাজ না চাপানো:
বেশি ঘনিষ্ঠ বলে অনেক সময় সহকর্মীদের উপর নিজের বেশ কিছু কাজ চাপিয়ে দিই। এতে নিজে আনন্দ পেলেও যার উপর সেই কাজের দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হল সে কিন্তু মনে মনে বিরক্ত হয়।
# সবার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি না করা:
একটা কথা মনে রাখবেন, সকলের সাথে বন্ধুত্ব করা কখনই ভাল নয়। যার সাতে যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই যথেষ্ঠ।
#কারোর ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কথা না বলা:
অফিসে আপনার যতই পরিচিত বা বন্ধুত্ব থাকুন না কেন অফিসে অন্যদের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কখনো কথা বল্বেন না।
# ভুল বোঝাবুঝি মানিয়ে চলা:
প্রথমেই বলেছি অফিস মানে পরিবারের বাইরে আরেকটি পরিবার। তাই ভুল বোঝাবুঝি, রাগ অভিমান হবেই। তাই বলে এমন আচরন করা যাবে না, যা সম্পর্ক নষ্ট করে। তাই মাথা ঠান্ডা রেখে সকল প্রতিকূল অবস্থা পাড় করতে হবে এবং তার পাশাপাশি সকলের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে।
# সম্পর্ক তৈরীর জন্য আলাদা করে সময় দেওয়া ও ছোট ছোট সৌজন্যতা দেখানোঃ:
কর্মক্ষেত্রে কাজের ব্যস্ততার মাঝে সহকর্মীর সাথে সম্পর্ক তৈরীর জন্য সময় রাখুন। কাজের খোঁজ নিন, পরিবারের খোঁজ নিন। চা/কফি ব্রেকের সময়ে নিজের জন্য এক কাপ বানানোর পাশাপাশি সহকর্মীর জন্যও এক কাপ বানান, বা জিজ্ঞাসা করুন। লাঞ্চের সময়ে একবার ডাকুন। সহকর্মীদের সাথে এইসব ছোট ছোট সৌজন্যমূলক আচরণ ভালো সম্পর্ক সৃষ্টির ক্ষেত্রে দারুন অবদান রাখে।
# অন্যদের অর্জনে আনন্দ প্রকাশ করা, এবং উৎসাহ দেওয়া:
একজন কর্মীর প্রোডাক্টিভিটি বাড়ানো, এবং কাজের প্রতি আন্তরিকতা সৃষ্টির জন্য তার ভালো অর্জন গুলোকে গুরুত্ব দেয়া ও তাকে অভিনন্দন জানানোর বিকল্প নেই। আপনার বস থেকে শুরু করে ক্লিনার বা দারোয়ান পর্যন্ত সবাই চায় তাদের ভালো কাজগুলো প্রশংসিত হোক। তাই – সহকর্মী যে পদেরই হোক না কেন, তাদের ভালো কাজ গুলোর আন্তরিক প্রশংসা করুন। আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানান, কর্মক্ষেত্রে এই আচরণ, আপনার প্রতি অন্যদের আন্তরিকতাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেবে।
# ইতিবাচক ও হাসিখুশি থাকা:
একজন মানুষ যদি সব সময়ে মন খারাপ করে থাকে, বা গোমড়া মুখে থাকে, অন্য লোকজন তার আশপাশে ভিড়তে চায় না। আপনি হাসিখুশি ও ইতিবাচক থাকলে অন্যরা আপনার কাছে আসতে এবং তাদের কথাগুলো বলতে উৎসাহিত হবে।
# অফিস পলিটিক্স ও বদনাম করা থেকে বিরত থাকা:
অফিস পলিটিক্স ও একজনের নামে অন্যের কাছে দুর্নাম করা সবচেয়ে ভয়ংকর আচরণ। যদি কারও সাথে আপনার মনোমালিন্য হয় – তবে সরাসরি তার সাথে এই বিষয়ে কথা বলুন, এবং বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করুন। মাঝে মাঝে হয়তো আপনার কাছেও অন্যের নামে কেউ দুর্নাম করবে – আপনি অবশ্যই সেই গসিপে যোগ দেবেন না। মনে রাখবেন, আপনার কাছে যে অন্যের নামে দুর্নাম করছে – সে আপনার নামেও অন্যের কাছে দুর্নাম করে।
সহকর্মীদের সাথে ভালো আচরণ ও তাদের সাথে সুসম্পর্ক রাখার উপকারিতা নিয়ে বলতে গেলে বলে শেষ করা যাবে না। আপনার ক্যারিয়ারের প্রতিটি পর্যায়ে, প্রতিটি ক্ষেত্রে সহকর্মীর সাথে ভালো সম্পর্ক দারুন সব সুবিধা দেবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আপনার কর্মদক্ষার চেয়েও এটা বেশি ফলাফল দেবে। কাজেই যতটা সম্ভব সহকর্মীদের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলনা।
রবিউল ইসলাম
Intern
Admin & HR