জীবন বহমান জটিলতা ও অতীব দুষ্কর এক মহাপ্রলয়ের নাম । প্রত্যেক মানুষের জীবনে এই জটিলতাপূর্ণ মহাপ্রলইয় নিগূঢ় থাকে যা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই । এই প্রেক্ষাপটে নারীর জীবনের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক কিংবা সামাজিক জীবনাচরণের সুস্পষ্টতা অনুধাবনে এবং তার ব্যাখ্যা জানতে আমাকে আগ্রহী করে তোলে প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার রচিত “সাতকাহন” উপন্যাসটি । আমি মনে করি, জীবনের প্রগাঢ় জটিলতা বোঝার জন্যে হলেও এই উপন্যাসটি পড়া প্রয়োজন । উপন্যাসটি পড়া শেষে উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র দ্বীপাবলি চরিত্রটি আমাকে বেশি আকর্ষিত করে ।
বাংলা ১৩৯৭ সাল, লেখকের শৈশব কাটে পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ার্সের চা বাগানে। হয়তো সেখানেই সাক্ষাৎ মেলে এই দীপাবলি চরিত্রের সাথে। কারণ, সাতকাহনে দেখতে পাওয়া যায় চা বাগানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব সুন্দর বর্ণনা। সেখানে বেড়ে উঠছে এক দুরন্তপনা বালিকা। চা বাগানের সহজ-সরল জীবিকা এই উপন্যাসের অন্যতম উপজীব্য বিষয়। অধিকাংশ পাঠক এড়িয়ে যান যে বিষয়টি তা হলো উপন্যাসের বর্ণিত এলাকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি, নগর গড়ে ওঠার কারণ এবং সাথে সাথে জীবিকার পরিবর্তন। দীপাবলির কঠিন হয়ে ওঠার সাথে সাথে চারপাশের পরিবেশটাও কেমন যেন কঠিন হয়ে উঠেছে, এই বিষয়টা দীপাবলি চরিত্রের আড়ালে মলিন হয়ে থাকে। কেননা উপন্যাসের শেষে সহজ সরল দীপাবলির পরিবর্তে এক কঠিন দীপাবলিকে চোখে পড়ে।
সমস্ত উপন্যাসে বিদ্যমান নানাবিধ চরিত্রগুলোর মধ্যে শুরুরদিকে পরিচিত হওয়া “রমলা সেন” এবং মাঝ পর্যায়ে পরিচিত হওয়া “অর্জুন নায়েক”চরিত্রের প্রতি আমার একটা আলাদা আগ্রহ এবং “অমল” চরিত্রের প্রতি ভালোলাগা তৈরি হয়েছে।তাছাড়া,ছোটো বেলার বন্ধু খোকন বড় হবার পরও দীপার সাথে যে সহজ বন্ধুত্ব দেখিয়েছে তাতে করে একজন সহজ বন্ধু পাওয়ার লোভ অল্প হলেও হয়েছে।
সাতকাহন একটা দীর্ঘ রচনা।একে অল্প কথায় সীমাবন্ধ করে তুলে ধরা দুষ্কর।অন্তত জীবনের জটিলতা বোঝার তাগিদের জন্যে হলেও বাঙালী প্রতিটি নারীকে তার জীবনের শুরুর দিকে একটিবার হলেও এই উপন্যাসটি পড়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।
বইটা শেষ করবার পর দীপাবলি চরিত্রটি আমাকে ভীষণভাবে আকর্ষণ করেছিল।একটা জীবন একা,আপোষহীন ভাবে,কোনো কিছুর সাথে মানিয়ে না নিয়ে নিজের মতোন করে চলবার প্রয়াস।
কিঞ্চিৎ হলেও পেয়েছিল,কিন্তু আস্তে আস্তে তা অনেকটা বিলীন হয়ে গেছে।কারণ হয়তো একা থাকা কঠিন সেইজন্য। একাকীত্ব খুব ভয়াবহ। মাঝে মাঝে মনে হয়, এই যে দীপা যে সব কারনে অলক কে ছেড়ে দিল কারণগুলো কি খুব বড় ছিলো,চাইলেই আলোচনা করে একসাথে থাকা যেত।সারাদিনের কাজ শেষ করে গভীর রাতে আকাশের দিকে তাকিয়ে যে শূন্যতা সে অনুভব করে এখন চাইলেই সে এই ব্যথার হাত থেকে বাঁচতে পারত।তবে জানিনা আমি এক্ষেত্রে ঠিক কি না!এখনও বইটার প্রতিটি ঘটনা আমাকে খুব ভাবায়।
সাতকাহন উপন্যাসটিতে বিংশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে পুরুষশাসিত সমাজে নারীর অবস্থান তুলে ধরার পাশাপাশি প্রকাশ পেয়েছে নারীবাদী চেতনা। প্রোটাগনিস্ট দীপাবলি জলপাইগুড়ির চা বাগানে বড় হওয়া এক কিশোরী, যার জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতের গল্প এই সাতকাহন। আপোষহীন-সংগ্রামী এই নারী চরিত্র নিঃসন্দেহে সমরেশ মজুমদারের অন্যতম সেরা সৃষ্টি। পুরুষশাসিত সমাজের বিরুদ্ধে লড়াকু যোদ্ধার গল্প। যে গল্প হাজারও মেয়ের জীবনকে বাঁচতে শেখায়। শুধুমাত্র বেঁচে থাকা নয়, নারীশিক্ষার বিষয়টিও গুরুত্বের সাথে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে উপন্যাসে।
উপন্যাসটি মূলত নারীকেন্দ্রিক একটি গল্প। সমাজের অনেক পিছিয়ে পড়া অবস্থা থেকে একজন মেয়ের উপরে উঠে আসার গল্প। মাত্র দশ বছর বয়স থেকেই দীপাকে অতিক্রম করতে হয়েছে নানা বাধা-বিপত্তি, মুখোমুখি হতে হয় কিছু অপ্রিয় সত্যের। চেনা জগতটা চটজলদি অচেনা হয়ে যায় দীপার। কিন্তু তবুও সে থেমে থাকেনি। নিরন্তর চেষ্টা চালিয়েছে নিজের সম্মান প্রতিষ্ঠার। নিজের মেধাকে কাজে লাগিয়ে অর্জন করেছে সাফল্য কিন্তু সাফল্য অর্জনের এই পথ মোটেও সহজ ছিল না তার জন্য। প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হয়েছে সমাজ, পরিবার, এমনকি মাঝে মাঝে নিজের সাথেও। একজন নারী যে পুরুষের চেয়ে কোনো অংশে কম না, তা দীপাবলি বুঝিয়ে দিয়েছে চোখে আঙুল দিয়ে।
দীপাবলী ছাড়াও আরো অনেকগুলো নারী চরিত্র এসেছে উপন্যাসটিতে। দীপাবলীর ঠাকুমা মনোরমা সেকালের মানুষ হয়েও অনেকের চেয়ে আধুনিক। চা বাগানকে ঘিরে যাদের জীবিকা, তাদের জীবন সম্পর্কে চমৎকার বর্ণনা পাওয়া যায় বইটিতে। বর্ণনাগুলো এতই নিখুঁত যে পড়ার সময় পাঠক চা বাগানে ঝির ঝির করে বৃষ্টি পড়ার ছবি দেখাটাও অদ্ভুত নয়। পঞ্চাশের দশকে ভারতে এমন অনেক জায়গা ছিল, যেখানে তখনও বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। এই উপন্যাসের চা বাগানটিও সে ধরনের একটি জায়গা যেখানে আধুনিক সভ্যতার পদচারণা সবে শুরু হয়েছে।
সমাজের ঘুণেধরা সংস্কারের বিরুদ্ধাচরণ করে সমাজে নিজের অবস্থান তৈরি করেছে এক নারী। সাধারণের মাঝেই দীপাবলির গল্প অসাধারণ। গল্পের শুরু থেকে শেষপর্যন্ত তার চরিত্রের বিকাশ এবং জীবনবোধের পরিবর্তন গল্পটিকে অন্য এক রূপ দিয়েছে। বাংলার প্রতিটি নারীই দীপাবলির মাঝে অল্প হলেও নিজেকে খুঁজে পাবে। কেউ হয়তো তার উপর হয়ে যাওয়া অন্যায়গুলোর শিকার, আবার কেউ হয়তো তার মতো অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে পেরেছে। দীপার জীবনে এসে মিশেছে নানা নাটকীয়তা, আর এসব নাটকীয়তাকে ছাপিয়েই যার জীবন এগিয়ে গেছে। চরিত্রটি প্রবল স্বকীয়তায় পরিপূর্ণ। লোভ, ঘৃণা, প্রেম, রিপুর তাড়না, বাঁচার ইচ্ছে, উচ্চাকাঙ্ক্ষা; সবমিলিয়ে সমরেশ মজুমদারের দীপাবলী। দুই খণ্ডের বিশাল উপন্যাসটি পড়তে পাঠকদের কখনওই একঘেয়েমি লাগবে না কারণ তারা কয়েক পৃষ্ঠা পড়েই দীপার জীবনের সাথে পরিচিতি অনুভব করবেন।
দীপাবলিকে যতই চেনা যায়, অবাক হতে হয়; কখনো বা তাকে মনে হয় অতি চেনা এক নারী। বিংশ শতাব্দীর নারীদের চিন্তা যে কতটা আধুনিক ছিল, তা এই উপন্যাস না পড়লে বুঝতে পারা যায় না। দীপাবলি, রমলা সেন আর মায়ার আধুনিকতা দেখে হয়তো বর্তমানের অনেকের চিন্তা-চেতনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে হয়।
আমাদের আরো ব্লগ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
Mahzabin Alam Tonny
Intern,Content Writing Department,
YSSE