“সানস্ট্রোক” এই শব্দটির সাথে আমরা সকলেই খুব ভালোভাবে পরিচিত। কি তাই না?
সানস্ট্রোক খুব সাধারণ এক ধরনের অসুস্থতার নাম। যা সাধারণত সকলের কাছে “হিটস্ট্রোক” নামেও পরিচিত। নাম আলাদা হলেও প্রভাবটা কিন্তু একই। সানস্ট্রোক তীব্র রোদের তাপে বা অত্যাধিক গরমে হয়ে থাকে। সানস্ট্রোক প্রধানত গ্রীষ্মপ্রধান দেশগুলোতেই বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে এপ্রিল থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত এর প্রভাব বেশি হয়ে থাকে। আমাদের দেশে এই সানস্ট্রোক দিন দিন বাড়ছে কেননা প্রতিনিয়তই পরিবেশের তাপমাত্রা বাড়ছে।
সানস্ট্রোকের ভয়াবহতা কীরূপ ?
সানস্ট্রোকে আমাদের শরীরের তাপমাত্রা আকস্মিকভাবেই ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইটেরও বেশি বেড়ে যায় এবং পাশাপাশি শারীরিক ও মানসিক ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। যেখানে একজন মানুষের শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৯৮.৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট। তাহলে অবশ্যই বুঝতে পারছেন, এভাবে হঠাৎ করে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া ঠিক কতটা মারাত্নক।
আপনারা কি জানেন? যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছরে ৬০০ জনেরও বেশি মানুষ সানস্ট্রোক বা হিটস্ট্রোকে মারা যান। অথচ আমাদের দেশে যেখানে সানস্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি এবং দিন দিন বেড়েই চলছে সেখানে কেউই এই অসুস্থতাকে গুরুত্ব দেয় না বললেই চলে। সারা দেশে সানস্ট্রোকে মৃত্যুর হার প্রায় ১০ থেকে ৫০ শতাংশ। তাহলে বুঝতেই পারছেন সানস্ট্রোক আমাদের জন্য কতটা ঝুঁকিপূর্ণ। এটি অনেক সময় আস্তে ধীরে ঘটে থাকে তবে আকস্মিকভাবে ঘটার সম্ভাবনাই বেশি। আপনারা যদি সানস্ট্রোক সম্পর্কে ভালো করে না জানেন তাহলে পরিস্থিতি সামলাতে সামলাতে অনেক দেরি হয়ে যাবে।
সানস্ট্রোক কাদের বেশি হয়ে থাকে এবং কি কি কারণে ?
সানস্ট্রোকের প্রধান কারণ আমরা সবাই জানি, সূর্যের তাপে সরাসরি আসা। এর ফলে যে কারোই সানস্ট্রোক হতে পারে। তবে শিশুরা, বয়স্করা, শারীরিক পরিশ্রম করা ব্যাক্তিরা এবং বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তিরা সানস্ট্রোক বা হিটস্ট্রোকের শিকার বেশি হয়ে থাকেন। বিশেষ করে যারা হৃদরোগ, কিডনি সমস্যা, ফুসফুসের সমস্যা, বর্তমানে জ্বরে ভুগছেন এবং আগেও সানস্ট্রোকের শিকার হয়েছেন তাদের সানস্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সানস্ট্রোক বা হিটস্ট্রোক হওয়ার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। যার সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই। তাহলে দেরি কেনো? চলুন জেনে নেই সেই কারণসমূহ-
- পরিবেশের উচ্চ তাপমাত্রায়
- সূর্যের তীব্র তাপে বেশিক্ষণ থাকলে বা শারীরিক পরিশ্রম করলে
- শরীরে পানি শূন্যতা বা মিনারেল কম হলে
- শীতল পরিবেশ বা এসি থেকে সরাসরি সূর্যের তাপে আসলে
- ডাই-ইউরেটিক্স, বিটাব্লকারস ও অ্যালকোহলসহ কিছু ঔষধের প্রতিক্রিয়ায়
- অতিরিক্ত গরমের মাঝে বেশি দুশ্চিন্তা করলে
- পানি কম পান করলে
- রোদে গরম চা বা কফি পান করলে
- গরমে তৈলাক্ত কিছু খেলে
- রাতে নিদ্রাহীনতায় ভুগলে
কীভাবে বুঝবেন সানস্ট্রোক হচ্ছে?
সানস্ট্রোক বা হিটস্ট্রোক যদিও হঠাৎ করে ঘটে তবুও এর বেশ কিছু লক্ষণ রয়েছে। সানস্ট্রোক ঘটার এই দ্রুত সময়ের মধ্যে যদি এর লক্ষণগুলো আপনারা ধরতে পারেন তাহলে নিজেকে এবং পরিস্থিতি খুব সহজেই সামলাতে পারবেন। তাহলে চলুন দেরি না করি জেনে নেই সেগুলো-
- আকস্মিকভাবে শরীরে তাপমাত্রা ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি বেড়ে যাওয়া
- মাথা ঝিম ধরা
- মাথা ঘুরানো
- দুর্বলতা
- বমি বমি ভাব
- ত্বক শুষ্ক ও লাল হয়ে যাওয়া
- ঘাম হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়া
- শ্বাস-প্রশ্বাস ঘন হওয়া
- হৃদপিণ্ড দ্রুত চলাচল করা
- হাঁটতে অসুবিধা হওয়া
- চোখে ঝাপসা দেখা
- চোখের মণি বড় হয়ে যাওয়া
- রক্তচাপ কমে যাওয়া
- শরীর গরম হয়ে যাওয়া
- শারীরিক ও মানসিক ভারসাম্যহীনতা
- গুরুতর হলে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া
এই লক্ষণগুলো দেখার সাথে সাথে যদি সঠিক ব্যবস্থা না নেওয়া হয় তাহলে সেখানেই আকস্মিক মৃত্যু হতে পারে।
আকস্মিকভাবে সানস্ট্রোক বা হিটস্ট্রোক ঘটলে প্রাথমিক চিকিৎসা কিভাবে নিবেন?
অনেকসময় সানস্ট্রোক এতই দ্রুত হয় যে কিছু করার সময়ই থাকে না। এক্ষেত্রে সাথে সাথে প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে মৃত্যু ঝুঁকির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। চলুন আজ জেনে নেই সানস্ট্রোক বা হিটস্ট্রোকের প্রাথমিক চিকিৎসাগুলো-
- তৎক্ষণাৎ সূর্যের তাপ থেকে দূরে নিয়ে যাওয়া
- খোলা বা শীতল স্থানে নিয়ে যাওয়া
- শরীর ঠান্ডা করার ব্যবস্থা করা
- মাথার তালুতে এবং চোখে-মুখে হালকা পানি দেওয়া
- আশেপাশে ভীড় না করা
- পানি খাওয়ানোর চেষ্টা করা
- চেচামেচি না করে শান্ত হতে দেওয়া
- জ্ঞান থাকলে খাবার স্যালাইন পান করানো
- শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিকভাবে চলছে কিনা খেয়াল রাখা
- দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া
এই প্রাথমিক চিকিৎসা নেওয়ার পরও যদি জ্ঞান না ফিরে বা শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক না হয় তাহলে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করুন।
সানস্ট্রোক থেকে কীভাবে নিজেদের বাঁচাবেন ?
সানস্ট্রোক কোনো মহামারী রোগ নয় যে এর থেকে বাঁচা অসম্ভব। কয়েকটি কার্যকরী সতর্কতা ও টিপস আগে থেকেই মেনে চললে এর থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব। তাহলে চলুন জেনে নেই সানস্ট্রোক বা হিটস্ট্রোকের ৬টি কার্যকরী সতর্কতা ও টিপস-
- সূর্যের ও গরমের তীব্রতা থেকে দূরে থাকুন
সানস্ট্রোকের প্রধান কারণই যেহেতু অতিরিক্ত সূর্যের তাপ। সেহেতু সূর্যের তাপ বা রোদ থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকার চেষ্টা করবেন। দুপুর ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত সূর্যের তাপ সবথেকে বেশি থাকে এবং গরমের পরিমাণটাও অতিরিক্ত থাকে। এই সময়ে সরাসরি সূর্যের তাপে কাজ করা থেকে বিরত থাকুন। এসির নিচে অনেকক্ষণ থাকলে সাথে সাথে রোদে বের হবেন না ভুলেও। যত গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে সেগুলো এই নির্দিষ্ট সময়ের আগে বা পড়ে করার চেষ্টা করবেন। তা যদি সম্ভব না হয় তাহলে অবশ্যই সবসময় ছাতা ও পানি সাথে রাখবেন।
- উপযুক্ত গ্রীষ্মকালীন পোশাক পরিধান করুন
ট্রেন্ড বা ফ্যাশনের থেকে বেশি জরুরী আপনার সুস্থতা। গ্রীষ্মের এই তীব্র গরমে হালকা রঙের পোশাক বেছে নিন। সুতি কাপড়ের ঢিলেঢালা পোশাক পড়ুন। এই ধরনের পোশাক সানস্ট্রোকের সম্ভাবনা কমাবে। পাশাপাশি গ্রীষ্মের এই অতিরিক্ত গরমের মধ্যে আপনি আরামও পাবেন।
- বেশি করে পানি পান করুন
সানস্ট্রোক বা হিটস্ট্রোক হয়ে থাকে সাধারণত শরীরে পানিশূণ্যতা দেখা দিলে বা মিনারেলের ঘাটতি থাকলে। তাই বেশি বেশি করে পানি পান করবেন। সবসময় নিজের সাথে আর কিছু রাখুন বা না রাখুন পানির বোতল অবশ্যই রাখবেন। এবং একটু পর পর পানি পান করবেন। এটি সবথেকে কার্যকর একটি পন্থা।
- সঠিক খাদ্যাভ্যাস গঠন করুন
সানস্ট্রোক হওয়ার পেছনে কিন্তু আমরা নিজেরাই বেশি দায়ী। বাহিরে গেলে তীব্র রোদের মধ্যে বেশি করে তৈলাক্ত খাবার, কোল্ড ড্রিংকস বা সুগার ড্রিংকস এবং গরম চা বা কফি বেশি গ্রহণ করে থাকি। যা আমাদের একদমই উচিত নয়। কেননা গরমের মধ্যে গরম ও তৈলাক্ত খাবার আমাদের শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত বাড়িয়ে দেয় এবং কোল্ড ড্রিংকস বা সুগার ড্রিংকসগুলো শরীরে ডিহাইড্রেশন বা পানিশূণ্যতা সৃষ্টি করে। তাই সূর্যের তীব্রতায় এগুলো খাওয়া থেকে বিরত থাকুন এবং সঠিক খাদ্যাভ্যাস গঠন করুন। বেশি করে সবজি জাতীয়, কম তেলযুক্ত খাবার গ্রহণ করুন। তেল ছাড়া খাবার খেলে তো আরও ভালো কিন্তু এটি সাধারণত কেউই করবে না তাই কম তেলযুক্ত খাবার খেতে পারেন। পানীয় খাদ্য বেশি করে খাবেন যেমন- ফলের রস, কম মিষ্টি জাতীয় পানীয় খাদ্য এবং বিশেষ করে পানি ও ডাবের পানি। এগুলো বেশি করে গ্রহণ করলে আপনাদের শরীরে পানিশূণ্যতা দেখা দিবে না এবং মিনারেলের ঘাটতি পূরণ হবে।
- রাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমান
রাতে ঘুম ভালো হলে শরীর ও মন এভাবেই সুস্থ ও সচল থাকে। রাতে যদি আপনারা পর্যাপ্ত পরিমাণে না ঘুমান তাহলে আপনাদের শরীরের তাপমাত্রা কমে যায় এবং শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে যদি আপনি তীব্র রোদের মাঝে সরাসরি যান তাহলে সানস্ট্রোক বা হিটস্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা সবথেকে বেশি থাকে। তাই রাতে ঘুম যেন ভালো হয় সেদিকে অবশ্যই খেয়াল রাখবেন।
- অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিন
সানস্ট্রোক বা হিটস্ট্রোক হঠাৎ করে ঘটলেও আমরা সকলেই কিন্তু কিছুটা হলেও বুঝতে পারি। রোদের তীব্র তাপমাত্রায় বাহিরে গেলে সানস্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা থাকেই। যদি আপনি এর লক্ষণ ধরতে পারেন বা আপনার শরীর খারাপ লাগে তাহলে সাথে সাথে কোনো ছায়াযুক্ত স্থানে বসে চোখ বন্ধ করে ফেলুন। এই টিপসটি সবসময় কাজে দেয়। আর বাসায় থাকলে সাথে সাথে পানির কল বা ঝরনা ছেড়ে সেটির নিচে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ বসে গোসল করে ফেলুন। একটু স্বাভাবিক হলে পানি বা খাবার স্যালাইন পান করুন। জ্বর থাকলে বা অসুস্থ হলে ভুলেও সূর্যের তাপে বা রোদে যাবেন না। বাহিরে গেলে অবশ্যই সানস্ক্রিন লাগাবেন এটি আপনার ত্বক সূর্যের তীব্রতা থেকে বাঁচাবে। প্রখর রোদে দাড়িয়ে থাকবে না। দরকার হলে ছাতা, সানগ্লাস ব্যবহার করুন আর একটু পরপর পানি পান করুন। তাপমাত্রার পরিবর্তন খেয়াল রেখে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিন।
পরিবেশের তাপমাত্রা যেভাবে দিন দিন বাড়ছে সেভাবেই পাল্লা দিয়ে সানস্ট্রোক বা হিটস্ট্রোকের সম্ভাবনাও বাড়ছে। যেকোনো সময়ই আকস্মিকভাবে আপনাদের সানস্ট্রোক হতে পারে। আপনারা যদি দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারেন তাহলে সহজেই সানস্ট্রোকের ভয়াবহতা থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারবেন। পাশাপাশি আপনাদের সামনেই যদি কেউ সানস্ট্রোকের শিকার হয় তাহলে তাৎক্ষনাৎ প্রাথমিক চিকিৎসার মাধ্যমে তাকেও সুস্থ করতে পারবেন। এরজন্য আপনাদের সানস্ট্রোক সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে জানতে হবে। পাশাপাশি অন্যদেরও জানিয়ে তাদের সুস্থ থাকতে উপকার করুন। সুস্থ থাকুন, সুস্থ রাখুন।
কাজী সায়মা সিমরান
ইন্টার্ন অফ কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
ওয়াইএসএসই।
আমাদের অন্যান্য ব্লগ গুলো পড়তে এখানে ক্লিক করুন।