“A woman’s heart is a deep ocean of secrets”- টাইটানিকে বুড়ো রোজের মুখের এই সংলাপটি মনে আছে? এটি নারীমনের গভীরতার সন্ধান দেয়।
মানব মনের চিন্তার ক্রিয়া বিক্রিয়া যতো জটিল, তাদের প্রকাশ তারচেয়েও বেশি মাপা। একই মনে কতো বৈপরীত্য! আছে নৈতিকতা-অনৈতিকতাবোধ, ভালোবাসা-ঘৃণা, সফেদ-কালো কিংবা আধার- আলো। বিশেষ করে নারীর চেতন অবচেতনের এই দোলাচল কে-ই বা পারতো পর্দায় তুলে ধরতে? পেরেছিলেন, আমাদের উপমহাদেশের একজন পেরেছিলেন, যার স্পর্শে একে একে প্রাণ ফিরে পেতো মনের অপ্রকাশিত চিন্তারা, এমনকি পুরুষের দেহ নিয়ে জন্মেও নারীত্বকে নিজের শরীরেও ঠাঁই দিয়েছিলেন যিনি। সেই একজন ঋতুপর্ণ ঘোষ।
Dream এবং Surrealism-কে কিভাবে রিলে ঠাঁই দিতে হয় তা ঋতু জানতেন। বাড়িওয়ালি মুভিটিতে তিনি এই অসাধ্য সাধন করে দেখিয়েছেন। এই সম্পর্কিত আলোচনার পূর্বে দেখে নেয়া যাক বাড়িওয়ালি চলচ্চিত্রটির আদ্যোপান্ত-
রেটিংঃ IMDb- 7.4/10
রিলিজ ডেটঃ ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০০০
দৈর্ঘ্যঃ ২ঘন্টা ৩৩ মিনিট
পরিচালনা, কাহিনী ও চিত্রনাট্যঃ ঋতুপর্ণ ঘোষ
অভিনয়েঃ কিরণ খের (বনলতা, বাড়িওয়ালি), চিরঞ্জিত চক্রবর্তী (পরিচালক দীপঙ্কর), রূপা গাঙ্গুলী (অভিনেত্রী সুদেষ্ণা), অভিষেক চ্যাটার্জি (অভিনেতা অভিজিৎ), সুদীপ্তা চক্রবর্তী (গৃহপরিচারিকা মালতী), সূর্য চ্যাটার্জি (ভৃত্য প্রসন্ন), শিবপ্রসাদ মুখার্জি (দেবাশীষ, ফিল্ম ইউনিটের সদস্য) প্রমুখ। এছাড়াও কিরণ খের ও চিরঞ্জিত চক্রবর্তীর চরিত্রে কন্ঠদান করেছেন যথাক্রমে রীতা কৈরাল ও সব্যসাচী চক্রবর্তী।
কাহিনী সংক্ষেপঃ
“হলো মধু মাসে বিয়া,
বাসর সাজাই মধু কলশ দিয়া….
হলুদ চন্দন দিয়া,
চাঁন্দের নন্দন বরণ করি গিয়া।
ধনবতী কইন্যা যে সোন্দর
চাঁন্দের নন্দন জামাই লখিন্দর।
……………………………….
চোখের জলে ভাসায় বাপে মায়,
পতির সনে চাঁদের পুরী যায়।
মধুমাসে মধুরও মিলন,
কলস কলস মধুর আয়োজন। “
মনসামঙ্গলের এই অদ্ভুত সুন্দর গানটির মাধ্যমেই বনলতার জীবন তুলে ধরা হয়েছে ছবিটিতে। রবি ঠাকুরের “চোখের বালি”, এই অনিন্দ্য সুন্দর গানটি এবং একাকিনী বনলতার জীবনকে এক করে যে অপূর্ব মালা গাঁথা হয়েছে তার নাম “বাড়িওয়ালি”। চাঁদ সওদাগরের পুত্রবধূ বেহুলার মত সিঁথিতে সিঁদুর ওঠেনি বনলতার, মনসাকে পরাজিত করে বরকে ফিরে পাওয়াও হয়নি তাঁর, তাও তাঁকে বরণ করতে হয়েছে অযাচিত বৈধব্য।
কাহিনী আবর্তিত হয় একদা সম্ভ্রান্ত বংশের অবিবাহিত ও নিঃসঙ্গ মধ্যবয়স্কা নারী বনলতাকে কেন্দ্র করেই। পুরো ছবি জুড়ে সরব উপস্থিতি ছিলো তাঁর এবং তাঁর নিঃসঙ্গতার।
শুরুর দৃশ্যেই দেখা যায় ভৃত্য প্রসন্ন সেটেলমেন্ট অফিসারকে বাড়ি ঘুরিয়ে দেখানোর সময় জানান বনলতাদের বংশে পুরুষদের অকাল মৃত্যুর শ্রাপ আছে। সেই শ্রাপের ছায়া পড়ে বনলতার বিবাহেও। সেই থেকে তাঁর এই বৈধব্যের জীবন, যে স্বামীর সাথে তাঁর কখনো বিয়েই হয়নি।
এরপর ঘটনা মোড় নেয় যখন বনলতার বাড়িতে “চোখের বালি” মুভির শ্যুটিংয়ের অনুমতি নিতে আসেন দীপঙ্কর নামক জনৈক পরিচালক। বনলতার রঙচটা একঘেয়ে জীবনে নতুন করে প্রাণ সঞ্চার হয়। শ্যুটিং টিমের সাথে নিজের অজান্তেই মিশে যায় সে। ক্যারিশম্যাটিক চরিত্রের দীপঙ্করের প্রতি বনলতা আগ্রহবোধ করতে থাকে। একদিন কাজের মেয়ে মালতী জানায় দীপঙ্কর বিবাহিত এমনকি এই চলচ্চিত্রটির নায়িকা সুদেষ্ণার সাথেও তাঁর একসময় গভীর প্রণয় ছিলো। স্বভাবতই বনলতার মনে তা ভিন্নভাবে প্রভাব ফেলে।
পরবর্তীতে বনলতা জানতে পারে স্ত্রীর সঙ্গেও দীপঙ্করের আক্ষরিক অর্থে কোনো সম্পর্কই নেই যদিও আইনগতভাবে তাঁরা আলাদা হয়ে যাননি। বাড়িওয়ালি বনলতার মায়া আরোও বাড়ে। ঘটনাচক্রে শ্যুটিংয়ে এক নারী চরিত্রের অভিনেত্রী আসেননি, দীপঙ্কর তখন দারস্থ হন বনলতার।দীপঙ্কর হয়তো জানতেন তাঁর প্রতি বনলতার আগ্রহের কথা। প্রথমবারের মত কারোর ডাকে সাড়া দিয়ে অন্দরমহল ছেড়ে বেরিয়ে আসেন তিনি। সেই ছোট্ট নারী চরিত্রে অভিনয়ও করেন।গল্প এগিয়ে যায়, বনলতা, সুদেষ্ণা আর দীপঙ্করের মনঃস্তাত্ত্বিক দোলাচল ত্রিমুখী অবস্থান নেয়।
যথাসময়ে, কাজ সেরে শ্যুটিং ইউনিট চলে যায়। এরপর বনলতার অন্যরকম অপেক্ষার শুরু হয়, সে প্রতীক্ষায় থাকে দীপঙ্করের চিঠির উত্তরের, প্রতীক্ষায় থাকে মুভিটি রিলিজ হবার।
কিন্তু কি হয় বনলতার জীবনে এরপর? বনলতা কি কেবল একদা সম্ভ্রান্ত বংশের ঐতিহ্যবাহী বাড়ির বাড়িওয়ালি হয়েই থেকে যান? দীপঙ্কর কি সঙ্গী হয় তাঁর? চলচ্চিত্রটি মুক্তির পর কি পালটে যায় তাঁর জীবন? মুভিটা কি আদৌ মুক্তিলাভ করে? বনলতার আকুল প্রতীক্ষারই কি সমাপ্তি ঘটে? এই প্রত্যেকটা প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে দেখে নিতে হবে “বাড়িওয়ালি”।
এবার বরং এই মুভির সবচেয়ে আগ্রহোদ্দীপক অংশ অর্থাৎ এর Dream sequence গুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক। Dream(স্বপ্ন) ও Surrealism (পরাবাস্তববাদ) নিয়ে খানিক আলাপে ফেরা যাক-
ঋতুর চোখে স্বপ্ন ও পরাবাস্তববাদঃ
পরাবাস্তববাদ শিল্পীদের ভাব প্রকাশের ভাষা হয়ে উঠেছিলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে, তা প্রায় ১৯২০ এর দিকে। দাদাইজমের পরপরই এর বিস্তার ঘটতে থাকে। পুঁজিবাদ ও অন্যায় যখন জেঁকে ধরতে শুরু করেছে কেবল, তখনই পরাবাস্তববাদ হয়ে উঠলো প্রতিবাদ প্রকাশের মাধ্যম। এই ঘরানায় বিশ্বাসী শিল্পীদের মতে, প্রকৃত সত্য লুকায়িত থাকে অবচেতন মনের গোপনে।
স্বপ্ন যেমন টুকরো টুকরো চেতন অবচেতনের মিশেলে সৃষ্টি হয় অনেকটা তেমন। সালভাদর দালির বিখ্যাত ” দ্যা পার্জিস্ট্যান্স অব মেমরি” এর একটি উদাহরণ।
বিচ্ছিন্ন ও আপাতঃ দৃষ্টিতে অযৌক্তিক ঘটনার সমন্বয়ে সত্য প্রকাশিত হয় স্বপ্নে।
ঋতুপর্ণ ঘোষের বাড়িওয়ালিতেই প্রথম বাংলা সিনেমায় পরাবাস্তববাদী ধারার স্বপ্নদৃশ্যের সার্থক চিত্রায়ণ হয়েছে।
স্বপ্নদৃশ্যের ব্যাখ্যা
পুরো মুভিটিতে তিনটি স্বপ্নদৃশ্য রয়েছে। এই এলোমেলো স্বপ্নগুলোই বনলতার মনঃস্তত্ত্বের প্রতিনিধিত্ব করে। স্বপ্নগুলোর সংলাপ এবং সম্পূর্ন খন্ড খন্ড উপাদান গৃহীত হয়েছে আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা হতে।
প্রথম স্বপ্নদৃশ্য-
এখানে বনলতা হাজির হয় হলুদ মাখা মুখে। ঠিক তাঁর বিয়ের আগেরদিনের মতো। এরপর মালতীকে সে অনুরোধ জানায় যেনো বরপক্ষকে কলাপাতায় খাবার পরিবেশন করে। মালতী জানায়- “ওরা খাবেনা, লুচি রাবড়িতে বেড়ালে মুখ দিয়েছে !”
মালতী প্রসন্নের কাছে গিয়ে আবারো কলাপাতা চায়, নারীর পোষাক পরিহিতা প্রসন্ন উত্তর দেয়-
“এ কলাগাছ তো দেয়া যাবেনা দিদি !
ভেলা তৈরি হবে যে, সাপে কাঁটা মরা তো তাই
কলার ভেলায় ভাসিয়ে দিতে হবে !”
মুহুর্তেই কলাপাতা ভিন্ন অর্থ ধারণ করলো। খাবার পরিবেশনের পাত্র থেকে হয়ে উঠলো মৃতদেহ ভাসানোর পাত্র। প্রাচীনকালে সাপে কাঁটা দেহ ভাসানোর জন্য কলাগাছের ভেলা ব্যবহৃত হতো, স্বপ্নের এই অংশে তাই দেখতে পাওয়া যায়।
এরই সাথে প্রসন্নের এই মেয়েলী সজ্জা নির্দেশ করে বনলতা কোন দৃষ্টিতে তাঁকে দেখে তা। যেহেতু এতোকাল ধরে প্রসন্নই অনেকটা মাতৃস্নেহে তাঁকে দেখভাল করেছে ও বাড়ির পুরুষ এবং মেয়েলি সকল কাজ সেই সামলেছে।
দ্বিতীয় স্বপ্নদৃশ্য-
এই স্বপ্ন দেখার আগেই বনলতার পরিচয় হয়েছে দীপঙ্করের সাথে। এখানে তাই দীপঙ্করের উপস্থিতিও আছে। এখানে দেখায় বনলতা দুধের পাত্র হাতে প্রবেশ করে যেটা কিনা এককালে সাধারণত নবপরিণীতা বাসর ঘরে প্রবেশের সময় করতো৷ কিন্তু অদ্ভুতভাবে তাঁর কপালে সিঁদুর কিংবা লাল শাড়ি নেই। বনলতা আগ্রহের সাথে জিজ্ঞেস করে দীপঙ্করকে-
” আচ্ছা ফাল্গুন মাসের আর কটা দিন বাকি বলুন তো ?”
দীপঙ্করকে দেখা যায় লাল রঙে দেয়াল রাঙিয়ে দিচ্ছে, পরক্ষণেই লাল রঙ সর্বত্র ছড়িয়ে পরে। দীপঙ্কর বলে ওঠে-
“পশ্চিম দিকে যাবেননা, রঙ কাঁচা আছে। ”
এই কাঁচা লাল রঙ বনলতার মনে সদ্য সৃষ্ট আকর্ষণের প্রতি ঈঙ্গিত করে।
এরপর স্ক্রু-ড্রাইভারে বই কেটে দিলে আবারো বনলতার মুখেও লাল রঙের ছিঁটে লাগে।
তৃতীয় স্বপ্নদৃশ্যঃ
এই স্বপ্নদৃশ্যে বনলতার দীপঙ্করের প্রতি তৈরি হওয়া নিজের দুর্বলতার প্রতি কোনোরকম সন্দেহ নেই। নিজেকে সমর্পণ করতে প্রস্তুত সে। তাঁর কামনার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে এই স্বপ্নে রূপকার্থে ব্যবহৃত হয়েছে একটা শাড়ি। যেখানে দীপঙ্কর বলে-
“বাহ ! সুন্দর হাতের কাজ তো আপনার !”
বলা বাহুল্য এটিও পূর্বে সংঘটিত হওয়া ঘটনার প্রতিফলন। কুঞ্চিত আলতা পায়ের মাধ্যমেও বনলতার সেই একই আকাঙ্খা প্রকাশ পায়।
কন্ট্রোভার্সিঃ
এই মুভির সবচেয়ে ইউনিক এবং অদ্ভুত দিক হচ্ছে প্রধান দুই প্রোটাগনিস্টের কন্ঠস্বর। হয়তো ঋতুপর্ণ কিরণ খের আর চিরঞ্জিতের চেহারা,অভিনয়, অভিব্যক্তি চাইতেন কিন্তু যে কন্ঠস্বর উনি কল্পনা করেছেন তা হয়তো সব্যসাচী চক্রবর্তী এবং রীতা কৈরালের গলার সাথে যায়। কিন্তু ডাবিং অন্যকেউ করেছেন তা বোঝাও যাবেনা কেননা বেশ নিখুঁতভাবে sync করা হয়েছে। কিরণ খের অবাঙালী তাও একবারের জন্যে মনে হবেনা।
এবার আসি কন্ট্রোভার্সিটা কি ছিলো তা নিয়ে…
“ন্যাশনাল এওয়ার্ড” পাওয়া নিয়েই “বাড়িওয়ালি” নানান জল্পনার সৃষ্টি করে। যেহেতু কিরণ খেরের চরিত্রটির ডাবিং করেছেন রীতা কৈরাল তাই ভারতীয় চলচ্চিত্রের কলাকুশলীদের জন্য সর্বোচ্চ সম্মানসূচক পুরস্কারের জন্য তিনিও যুগ্মভাবে সম্মানিত হতেন। কিন্তু রীতা কৈরাল যে ডাবিং করেছেন তা ফিল্ম প্রোমোট করার সময় পুরোপুরি বাদ দেয়া হয়। প্রোডিউসার অনুপম খেরের নির্দেশেই তা করা হয়। ঐ সময় মুখ না খুললেও ঋতুপর্ণ ঘোষ পরবর্তীতে তা স্বীকার করেন। তাই যতবার বাড়িওয়ালির নাম আসে, তার সাথে সাথে আসে এই বিখ্যাত কন্ট্রোভার্সিও।
সবকিছুর সন্মিলনে “বাড়িওয়ালি” বাংলা চলচ্চিত্রের এক অভূতপূর্ব সৃষ্টি। আটপৌরে বাঙালী নারীর চরিত্রটি শিখিয়ে দেয়, একাকিত্ব আমরা ততক্ষণ সয়ে যেতে পারি যতক্ষণ সেই একাকিত্বের জ্বালা বাড়িয়ে দেবার জন্যে না কেউ উপস্থিত হচ্ছে। এতোসব অসাধারণত্বে ভরপুর এই ছবিটি পাঠক নিশ্চয়ই মিস করতে চাইবেন না?
আমাদের অন্য ব্লগগুলো পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
নিশাত আজাদ ছোঁয়া
ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE