৫০ বছরে ঢাকার কিরূপ পরিবর্তন!!!
প্রাচীনকালে বুড়িগঙ্গা নদীর তীর ঘেঁসে গড়ে উথেছিল একটি জনপদ। এককালে এর নাম ছিন জাহাঙ্গীর নগর। কালের বিবর্তনে জাহাঙ্গীর নগর থেকে আজকের এই ঢাকায় পরিনিতি কিন্তু একদিনে ঘটে নি। পাল রাজা বা তারও আগে রাজা বাদশাহরা শাসন করে গেছেন। এর পর ইংরেজরা প্রায় ২০০ বছর ধরে শাসন করল। এর পর পশ্চিম পাকিস্তানীরা আরও ২৪ বছর শাসন করে যায়। এক সময় সকল ঝামেলা থেকে মুক্ত হয় এই প্রান প্রিয় ঢাকা। বুড়িগঙ্গার পাড়ের সেই এলাকা আজ দেশের রাজধানী এবং অন্যতম ব্যস্ততম নগরীতে পরিণত হয়। ঢাকার যে অংশ বুড়িগঙ্গার পাড়ে ছিলো তা এখন পুরান ঢাকা নামেই মানুষ চিনে। এছাড়া মতিঝিল, বনানী, উত্তরা, মিরপুর, ধানমন্ডি, বসুন্ধরা সহ আরও অনেক জায়গা বলতে গেলে ঢাকার প্রাণকেন্দ্র। পুরাতন ঢাকা এখন আর শহরের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্র নয়। কিন্তু সদরঘাট এখনও তার স্থায়ী আন্দোলন ও বৃদ্ধির সংজ্ঞা বুকে বয়ে নিয়ে রয়েছে।
স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের গতিপথ প্রতিফলিত হয়েছে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। সে সময় ঢাকা একটি দরিদ্র ও অনুন্নত জাতির লক্ষ লক্ষ আত্মার একটি ছোট শহর ছিল। এখন ঢাকা একটি মেগাসিটি, একটি অর্থনৈতিক কেন্দ্র যা বিশৃঙ্খলভাবে বেড়ে উঠছে প্রতিনিয়ত, বাইরে এবং ঊর্ধ্বমুখীভাবে- এখানে বসবাসকারী ৩ কোটি মানুষকে শোষণ করার জন্য। এখানে প্রতি বছর ৪০০,০০০ লোক আসছে যাদের মধ্যে অনেকে অর্থনৈতিক সুযোগের স্বপ্ন নিয়ে অন্যত্র থেকে চলে এসেছে ইট পাথরের এই শহরে।
আজকের এই ব্যস্ত ঢাকা, ২০ বছর আগেও এমন ছিলো না। আমরা ৯০ এর দশকের দিকে তাকালে দেখা যাবে, হাতে গোনা উচু অট্টালিকা, রাস্তা ভর্তি নেই গাড়ির যানজট। দিন যত বাড়ছে মানুষ কাজের তাগিদে এই রাজধানীতে পাড়ি জমাচ্ছে। কেউ হয়তো সফলতা পাচ্ছে; তো কেউ ঝুড়ির তলানিতেই রয়ে যাচ্ছে।
১৯৭১ সালে হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে অর্থনীতির ঝুড়ির তলানি হিসেবে বর্ণনা করেন। আজ অর্ধ-শতাব্দী পরে, দেশটির নেতারা প্রায়ই গর্ব বোধ করেন যে তারা তাকে ভুল প্রমাণ করেছে। অক্টোবর মাসে ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ড (আইএমএফ) ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল যে গত বছরের প্রবৃদ্ধি অর্ধেক করা সত্ত্বেও ২০২১ সালে দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৪.৪ শতাংশে আঘাত হানবে।
ঢাকা এখন শিল্প ভিত্তিক নগরীতে পরিণত হয়েছে যা অতি-ধনীদের একটি দ্রুত বর্ধনশীল শ্রেণীর জন্ম দিয়েছে। যারা আবাসিক এলাকায় বাস করে, আন্তর্জাতিক রেস্তোরাগুলোতে খাওয়াদাওয়া করে এবং উজ্জ্বল অতি রঞ্জিত শপিং মলে বা বিদেশে কেনাকাটা করে। এই শহরে যেমন অট্টালিকায় বসবাস করা মানুষ বাস করে তেমনি মধ্যবিত্ত শ্রেনীর মানুষও বাস করে যারা ৩ বেলা খেয়েপড়ে সাচ্ছন্দে থাকতে পারছে। আবার এই দুই শ্রেণির মানুষদের বাদ দিলে আরও একশ্রেণীর মানুষও আমরা প্রতিনিয়ত দেখে থাকি যারা জীবনযুদ্ধে কোনো রকমে একবেলা খেয়ে তো আর একবেলা না খেয়ে বেঁচে থাকার অন্তিম চেষ্টা করে যাচ্ছে। আসলে এই ঢাকা যে শুধু ধনীদের সেটা কিন্তু একদম ভুল কথা। এখানে নানা কিসিমের মানুষের বাস।
আবাসিক ভবনগুলো পরিকল্পনা আইনের প্রতি কোন শ্রদ্ধা রেখে উঁচু হতে থাকে। ভবনের মধ্যে যে সামান্যতম জায়গা আছে তাতে দেখা যায় বিদ্যুতের তার গিঞ্জিমিঞ্জি অবস্থায় নিচে ঝুলে রয়েছে। নর্দমা ব্যবস্থা এখনও ম্যানুয়ালি পরিষ্কার করা হয় এবং একটু ভারী বর্ষণের ফলে টইটুম্বুর হয়ে যায় নিমিষেই। ঢাকার বাতাসের মান নিয়মিতভাবে বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ এবং রাস্তায় এত গাড়িঘোড়া যে ট্রাফিক প্রায় ৪ মাইল ধীর গতিতে চলে, যা এক দশক আগেও প্রায় ১৩ মাইল প্রতি ঘন্টায় চলতো।
কি নেই এই শহরে!!! আসলে অনেক কিছুই নেই। এতোসব নেই এর মাঝেও আছে মানুষ, আছে রাস্তাঘাট, আছে ধুলোবালি, আছে আমার আপনার কর্মব্যস্ত সময় আর আছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যাম। এখানে মানুষ স্বপ্ন বেচতে ও স্বপ্ন কিনতে আসে। এই কেনার বেচার ভিড়ে কেউ হারিয়ে যায় কেউ বা গন্তবে পৌছাতে পারে।
এই শহরে পড়ালেখার জন্য রয়েছে শত শত স্কুল কলেজ এমকি দেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ও। হোক সে ধনী হোক সে গরিব, পড়াশোনার জন্য সমান ব্যবস্থা থাকলেও নেই পর্যাপ্ত সুযোগসুবিধা। যার জন্য একশ্রেণীর মানুষ এখন পড়ালেখায় পিছিয়ে থেকে জীবন চালানোতে ব্যস্ত।
স্বাস্থ্য চিকিৎসা নিয়েও এই শহরে বিশাল অবস্থা। আশে পাশে অনেক হাসপাতাল চোখে পরলেও সবগুলোর ব্যবস্থা খুব একটা ভালো নয়। এইখানেও বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়। এক শ্রেণীর মানুষ পর্যাপ্ত চিকিৎসা পেলেও আর এক শ্রেণীর মানুষ তুলনামূলক কম পায়। তার পরেও গত ৫০ বছরে এই শহরের স্বাস্থ্য চিকিৎসা অনেক উন্নত হয়েছে।
খাবার দাবার এর কথা বললে প্রথমেই চোখে পরবে স্ট্রিট ফুড। এই শহর পরিচিত তার স্ট্রিট ফুড এর জন্য। অলিতে গলিতে ব্যস্ত সড়কের পাশে, শপিং মল থেকে শুরু করে অফিসপাড়া সব জায়গায় খাবার এর বিশাল সমাহার। এতো খাবারের ভিড়েও সেই ঘুরে ফিরে এক শ্রেণির মানুষ ২ বেলা ২ মুঠো অন্ন যোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ঢাকার প্রায় ৭০ শতাংশ পরিবার প্রতি মাসে ১৭০ ডলারের কম আয় করে। ৪০ শতাংশের নিচে যে অর্ধেকেরও কম বাড়ি ভাড়া স্বরূপ নিয়ে যায়। ঢাকায় আসা বেশীরভাগ অভিবাসী গ্রামের জীবনকে পিছনে ফেলে ঢাকায় আসে।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার সময় বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা চরম বেহাল দশায় ছিল, রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের জন্য সব কিছু বলতে গেলে গোড়া থেকে শুরু করতে হয়েছে। জনসংখ্যার ৮০% চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করছিল। পরবর্তী বছরগুলোতে দেশটি সামরিক অভ্যুত্থান, রাজনৈতিক অস্থিরতা, দারিদ্র্য এবং দুর্ভিক্ষের সাথে সংগ্রাম করে। এতো সংগ্রামের পরেও আজকের এই অবস্থা সত্যিই প্রশংসনীয়।
ঢাকা ১৯৭১ সালের পর থেকে বিস্ময়কর প্রবৃদ্ধি এবং দ্রুত উন্নয়ন দেখেছে। এটি বাংলাদেশের জন্মের পর থেকে একটি নিছক প্রাদেশিক শহর থেকে একটি জাতির রাজধানীতে পরিণত হয়েছে। এটি বিশ্বের একমাত্র সাতটি শহরের একটি যেখানে ১৯৭৫ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে শহুরে অধিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের অভিজ্ঞতা হয়েছে (জাতিসংঘ ২০০৬)। এটি ২০১১ সালে বিশ্বের শীর্ষ দশ মেগাসিটির একটি ছিল। দুর্ভাগ্যবশত, উন্নয়ন একটি অপরিকল্পিত উপায়ে ঘটেছে, বিশেষ করে 1990 সালের পর থেকে।যার ফলস্বরূপ আজকাল ঢাকা নামটি নিয়মিতভাবে সবচেয়ে অপছন্দনীয় শহরের তালিকায় উঠে আসে।
ঢাকা বাংলাদেশের আর্থিক, বাণিজ্যিক ও বিনোদনের রাজধানী। এটি বাংলাদেশের মোট অর্থনীতির ৩৫% অবদান রাখে। বিশ্বায়ন ও বিশ্ব নগর গবেষণা নেটওয়ার্ক ঢাকাকে একটি বৈশ্বিক শহর হিসেবে স্থান দিয়েছে। অন্য কথায়, যা তাদের অঞ্চলকে বিশ্ব অর্থনীতির সাথে সংযুক্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শহরটি দেশের আর্থিক কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বৃহত্তম স্টক মার্কেট ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের আবাসস্থল। শহরের প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিল, দিলকুশা, গুলশান, বনানী, কাওরান বাজার এবং মহাখালী। প্রধান শিল্পাঞ্চল গুলো তেজগাঁও, শ্যামপুর ও হাজারিবাগ। পেডেলার, ছোট দোকান, রিকশা পরিবহন, রাস্তার পাশের বিক্রেতা এবং স্টল জনসংখ্যার একটা বড় অংশ এই ঢাকা শহরেই থাকে। শুধুমাত্র রিকশা চালকদের সংখ্যা ৪০০,০০০ এর মত। অর্ধেক কর্মী গৃহস্থালী এবং অসংগঠিত শ্রমে নিযুক্ত করা হয়, যখন প্রায় ৮০০০০০ বস্ত্র বা পোশাক বা গার্মেন্ট শিল্পে কাজ করে। বেকারত্বের হারের দিক দিয়ে ঢাকা এশিয়ার মধ্যে ৬ষ্ঠ স্থানে আছে (৪.৮১%)।
ঢাকা সম্ভবত বিশ্বের খুব কম মেগাসিটির মধ্যে একটি যেখানে কোন যথাযথ পরিকল্পিত নকশা নেই। আমাদের মত আরও কয়েকজন আছে, কিন্তু তাদের কারোরই প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ৫০,০০০ জনসংখ্যার ঘনত্ব নেই। কিছু অনুমান অনুযায়ী, ২০৩০ ও ২০৫০ সালের মধ্যে ঢাকায় যথাক্রমে ২৪ মিলিয়ন ও ৩৫ মিলিয়ন মানুষ বসবাস করবে। সুতরাং, যদি ঢাকাকে “উন্নয়ন” এবং “নগরায়ন” নামে বেঁচে থাকতে হয়, তাহলে শুধু কাগজে কলমের নির্দেশিকা প্রদান করা নয়, বাস্তবে বাস্তবায়নের জন্যও একটি যথাযথ পরিকল্পনা থাকতে হবে।
শত কষ্টের পরেও মানুষ ঢাকায় আসে নতুন স্বপ্ন নিয়ে, নতুন করে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে শামিল হতে। কথায় আছে আশায় বাঁচে মানুষ। অর্ধেক ঢাকাবাসী এই আশা নিয়েই প্রতিদিন যুদ্ধ শেষ করে বাসায় ফিরে পরের দিনে যুদ্ধে জাবার প্রস্তুতি নিতে। আর এভাবেই এগিয়ে চলছে ঢাকা। প্রতিদিন নতুন নতুন অট্টালিকা হচ্ছে, রাস্তায় নতুন নতুন গাড়ি নামছে, বাড়ছে ঢাকার জনসংখ্যা। একদিন হয়তো ঢাকা বসবাসের একেবারে অযোগ্য হয়ে উঠবে। তার আগেই এই ঢাকাকে বদলাতে হবে। আর ঢাকা বদলানোর জন্য সবার আগে আমাদের নিজেদেরই এগিয়ে আসতে হবে আমাদের প্রানের ঢাকাকে বাঁচাতে।
To know more about Dhaka city, do visit Dhaka city
Tonmoy Dash/ YSSE intern