ভ্রমণ করতে কার না ভালো লাগে বলেন! কিন্তু বাংলাদেশের মত একটা জায়গায় ভ্রমণ করাটা বেশ কষ্টসাধ্য। যেখানে ছেলেদেরই ভ্রমণের অনুমতি পেতে বহু কাঠখড় পোহাতে হয় সেখানে মেয়েদের ঘোরাঘুরি যেন অনেকটাই কেবল কল্পনার মত। আচ্ছা সেখানে যদি দুজন ডাক্তার মেয়ে এমন একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে যা ভ্রমণের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে কাজ করে। সেটা কি আদৌ সম্ভব?
কি অবাস্তব মনে হচ্ছে? অবাস্তব মনে হলেও এটি সত্যি। Youth School for Social Entrepreneurs (YSSE) আয়োজিত “Behind the Journey” এর বিভিন্ন এপিসোডে এমন কিছু ব্যক্তিদের নিয়ে আসা হয় যারা তাদের কর্মক্ষেত্রে ও জীবনে সফল বা এমন কোনো কাজ করছেন যেটা তারাই প্রথম করেছিলেন। আর এর উদ্দেশ্য হলো তরুণ সমাজকে অনুপ্রাণিত করা যেন তারাও এমন কিছু করে সফল হতে পারে।
এরই ধারাবাহিকতায় গত ৪ই জুলাই, রবিবার রাত ৮ঃ০০ টায় “Behind the Journey” এর ৫১ তম পর্বটি আয়োজিত হয়। এ পর্বটিতে অতিথি হিসেবে ছিলেন “ট্র্যাভেলিটস অফ বাংলাদেশ- ভ্রমণকন্যা” এর প্রেসিডেন্ট সাকিরা হক। অপারেশন ম্যানেজমেন্ট ইন্টার্ন মাইশা রহমান চৈতি এর সঞ্চালনায় এই পর্বটি Youth School for Social Entrepreneurs (YSSE) এর ফেসবুক পেইজ থেকে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়।
নিশ্চয়ই ভাবছেন “ট্র্যাভেলিটস অফ বাংলাদেশ- ভ্রমণকন্যা” আবার কি এবং কেন সাকিরা হককে অতিথি হিসেবে নিয়ে আসা। তাহলে চলুন এর উত্তরস্বরূপ জেনে নেওয়া যাক “ট্র্যাভেলিটস অফ বাংলাদেশ- ভ্রমণকন্যা” সম্পর্কে।
“ট্র্যাভেলিটস অফ বাংলাদেশ- ভ্রমণকন্যা” বাংলাদেশের প্রথম ও বৃহত্তম মহিলা অনলাইন ভ্রমণ সংস্থা যার মধ্যে ৫৫,০০০+ মহিলা সদস্য রয়েছে যার লক্ষ্য ভ্রমণের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন করা। এটি ইতিমধ্যে ৫০০++ ভ্রমণার্থীদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে ৮৩ টি ইভেন্ট পরিচালনা করেছে। প্রথমবারের মত ভ্রমণ এবং ভ্রমণ ফটোগ্রাফি নিয়ে এই সংস্থার অধীনে টানা তিন বছর ধরে ট্র্যাভেলাইটস ফটোগ্রাফি প্রদর্শনী আয়োজিত হচ্ছে।
“ট্র্যাভেলিটস অফ বাংলাদেশ- ভ্রমণকন্যা” – এর দুই প্রতিষ্ঠাতা ডা. সাকিরা হক এবং ডা. মানসী সাহা “Narir chokhe Bangladesh-নারীর চোখে বাংলাদেশ” প্রোগ্রামের আওতায় বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দুটি মোটর সাইকেল নিয়ে সারাদেশ ভ্রমণ করেছেন। তারা সেখানে প্রতিটি জেলায় দুই বা ততোধিক বিদ্যালয়ে কর্মশালার ব্যবস্থা করে এবং ছাত্রছাত্রীদের সাথে মাসিক স্বাস্থ্য, আত্মরক্ষা, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ সম্পর্কে আলোচনা করেন। এখন তারা এই প্রোগ্রাম ছাড়াও এই প্রোগ্রামটির বর্ধিত সংস্করণ পরিচালনা করছেন।
অতিথির ছাত্রজীবন
অতিথির ছাত্রজীবন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছেটা খুব ছোটবেলা থেকেই ছিল। অনেকটা বলতে পরিবারের ইচ্ছার পাশাপাশি জন্মটা ঢাকা মেডিকেলে হওয়ায় সেখান থেকে মেডিকেল বিশেষ করে ঢাকা মেডিকেলের প্রতি খুব ফ্যাসিনেশন ছিল। স্কুল কলেজ লাইফে তথাকথিত সিরিয়াস শিক্ষার্থীদের মত অনেক পড়াকু ছাত্রী থাকলেও মেডিকেল লাইফে পড়াশোনার পাশাপাশি বেশ মজাও করেছেন।
অন্যান্য সবার মত আমাদেরও অনেকের ধারণা মেডিকেলে পড়াশোনা করলে নিজেকে সময় দেয়া যায় না বা বন্ধুদের সাথে হ্যাংআউট ও করা যায় না। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে ডা. সাকিরা হক বলেন, এটা আসলে মানুষভেদে আলাদা হয়। অনেকের একটা পড়া পড়তে মাত্র দেড় দুই ঘন্টা লাগলেও অনেকের এই একই পড়া পড়তে ৫-৬ ঘন্টা সময় লাগে।
অতিথির ক্যারিয়ার
পর্যটনকেন্দ্র কক্সবাজারে কাজ করার অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ২০১৯ সালের ৮ ই ডিসেম্বর ইমারজেন্সি মেডিকেল অফিসার হিসেবে প্রথমে টেকনাফে পোস্টিং হয়। টেকনাফের একটা প্রোগ্রামে ডা. সাকিরা হক একটা প্রেজেন্টেশন দেয়ার পর ২০২০ সালের জুনে কক্সবাজারের সিভিল সার্জেন স্যার ওনাকে কক্সবাজারে নিয়ে আসেন। এরপর অক্টোবরে আবার টেকনাফে চলে গেলেও এ বছর আবার তিনি কক্সবাজারে কাজ করা শুরু করেন। তিনি আরো যোগ করেন, কক্সবাজারে এসে তিনি অনেক নতুন কিছু শিখেছেন এবং শিখছেন।
তিনি যেহেতু একজন ডাক্তার এবং একজন ডাক্তার হিসেবে করোনার রোগীদের খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন, সেক্ষেত্রে করোনা চলাকালীন নিজের এবং পরিবারের সুরক্ষার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেহেতু উনি সরাসরি করোনা রোগীদের সাথে কাজ করেছেন তাই শুরুতে প্রথম ৬-৭ মাস তিনি বাসায় যাননি এবং ওনার মা কেও খুব সচেতনতার সাথে বাসার বাইরে যেতে মানা করেছেন। এর পাশাপাশি তিনি প্রায় ৩-৪ মাসের বাজারও করে দিয়েছিলেন এক ভলিন্টিয়ারের মাধ্যমে।
ভ্রমণ কি শুধু আনন্দঘন নাকি শিক্ষণীয়ও এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটাকে তিনি শিক্ষণীয় হিসেবেই দেখেন। আর এর উদাহরণস্বরুপ তার জীবনের গল্পও শেয়ার করেন। তিনি আরো বলেন ভ্রমণের মাধ্যমে তিনি তার নিজের মধ্যের অনেক নেগেটিভ দিকগুলো বদলাতে পেরেছেন।
ট্র্যাভেলিং প্যাশন
ট্র্যাভেলিং প্যাশন নিয়ে জানতে চাইলে বলেন, মেডিকেল লাইফের থার্ড ইয়ারের ঘটনাটা ভ্রমণের পিছনে পুশ হলেও প্যাশন টা এসেছে ছোট বেলা থেকে। আর মানুষ যেহেতু রিভার্স সাইকোলজিতে কাজ করে তাই কনজারভেটিভ ফ্যামিলি হওয়ায় নিজের মধ্যে ঘোরার খুব তাড়না বোধ করতেন। সেখান থেকেই এই ঘোরাঘুরির শুরু।
“ট্র্যাভেলিটস অফ বাংলাদেশ- ভ্রমণকন্যা“ এর শুরুর পেছনের গল্প
মূলত ঘোরাঘুরি করার ইচ্ছা আর একসাথে অনেকে থাকার বিভিন্ন সুবিধা যেমন সেভিংস, নিরাপত্তা, থাকার সুবিধা ও যাতায়াতের সুবিধার কথা বিবেচনা করেই এই সংস্থা শুরু করা। ২০১৬ সালের ২৭শে নভেম্বর যাত্রা শুরু হওয়ার পর থেকে আজ অবধি পথচলা যার বর্তমান মোট সদস্য প্রায় ৫৯ হাজার।
“ট্র্যাভেলিটস অফ বাংলাদেশ- ভ্রমণকন্যা“ এর সফলতা
বর্তমানে সংস্থার অনেক মেয়েরা গ্রুপ করে “ট্র্যাভেলিটস অফ বাংলাদেশ- ভ্রমণকন্যা” সংস্থার প্রত্যক্ষ সাহায্য ছাড়া ভ্রমণ প্ল্যান করে সেটা সফলভাবে বাস্তবায়ন করে। ডা. সাকিরা হক এটাকেই তার সফলতা হিসেবে দেখেন। এছাড়াও তিনি উইমেন এম্পোয়ারম্যান্ট এ অবদানের জন্য প্রিন্সেস ডায়না এওয়ার্ড ২০২০, একুমেন্ট ফেলোশিপ ২০২১, জয়বাংলা ইয়ুথ এওয়ার্ড ২০১৮ পেয়েছেন।

“Behind The Journey”(পর্ব – ৫১) – ভ্রমণকন্যা Dr. Sakira Haque ও তার Travelettes of Bangladesh এর গল্প
অন্যতম আকর্ষণ “র্যাপিড ফায়ার রাউন্ড”
প্রশ্ন ১ঃ কোন পরিচয়ে পরিচিত হতে বেশি ভালো লাগে ডাক্তার নাকি ভ্রমণকন্যা?
উত্তরঃ প্রথমে ডাক্তার এরপর ভ্রমণকন্যা ।
প্রশ্ন ২ঃ আপনার চোখে বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর জায়গা কোনটি?
উত্তরঃ শ্রীমঙ্গল, বান্দরবান, রাঙামাটি, নওগাঁ, শেরপুর ।
প্রশ্ন ৩ঃ অনুপ্রেরণা কে?
উত্তরঃ বাবা।
প্রশ্ন ৪ঃ ডাক্তার বা ট্রাভেলার না হলে কি হতেন?
উত্তরঃ চারুকলায় পড়ে আর্টিস্ট।
প্রশ্ন ৫ঃআত্মজীবনীমূলক বই এর নাম কি হবে?
উত্তরঃ ৬৪ জেলায় মোটরসাইলেকের কাহিনী।
প্রশ্ন ৬ঃ ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে একজনকে বেছে নিলে কাকে নিবেন?
উত্তরঃ ডা. মানসী সাহা
প্রশ্ন ৭ঃ জীবনের সবচেয়ে বড় সফলতা কোনটি?
উত্তরঃ ৬৪ জেলায় ঘোরাকালীন স্কুলে কর্মশালা শেষ করার পর ছাত্রীদের বাইকের উপর এসে হুমরী খেয়ে পড়া।
প্রশ্ন ৮ঃ কোনো স্বপ্ন আছে যা পূরণ করা হয়নি?
উত্তরঃ বয়সের সমান দেশ ঘুরতে চাওয়ার স্বপ্নে এখনো পিছিয়ে থাকা।
প্রশ্ন ৯ঃ প্রিয় উক্তি?
উত্তরঃ কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতা পুরোটাই।
প্রশ্ন ১০ঃ বাবা মায়ের প্রতি কোনো ম্যাসেজ?
উত্তরঃ প্রফেশন বা ইউনিভার্সিটির সাবজেক্ট চাপিয়ে দেয়া।
ভ্রমণের সবচেয়ে মজাদার ঘটনার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, অভিজ্ঞতা অনেক আছে। এর মধ্যে মোটর সাইকেলের অভিজ্ঞতা, রাঙামাটিতে মারমা পাড়ায় থাকার অভিজ্ঞতা, জোনাকী ভরা মাঠ দেখা , সুর্যোদয় দেখা এইগুলা অনেক সুন্দর অভিজ্ঞতা।
অনেক বাবা- মা আছেন যারা সন্তানদের ঘুরতে যেতে দিতে চান না তাদের সম্পর্কে কিছু বলতে চাইলে তিনি বলেন, বাবা- মা কে তিনি বলতেন তাদের সাথে গিয়ে ঘুরে আসতে। ফ্রেন্ডলি আচরণ করে সন্তানকে বোঝা। নইলে অন্তত নিজেদের সাথে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া।
এভাবেই বাবা-মা, শিক্ষার্থী, যুবসমাজ সহ দর্শকদের নানান পরামর্শ, দিকনির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা দিয়ে ডা. সাকিরা হক বিহাইন্ড দ্যা জার্নির এই পর্বটি শেষ করেন। ওয়াইএসএসই পরিবার সংস্থাটি এবং অতিথিকে সাধুবাদ জানায় এবং আশা করে একটি সাফল্যমণ্ডিত ভবিষ্যতের। পাশাপাশি আশা ব্যক্ত করে এভাবেই তরুণদের হাতে ধরেই আমাদের দেশ একদিন উন্নতির উচ্চ শিখরে পৌঁছে যাবে।
সফল উদ্যোক্তাদের পথ পরিক্রমা সম্পর্কে জানতে এবং তাদের কাছে নিজেদের জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজে পেতে, চোখ রাখুন YSSE এর পেইজে।
আমাদের আরো ব্লগ পড়ুন – এখানে
Author
Mahmuda Sultana Mim
Intern, Content Writing Department
YSSE