একজন সফল ব্যবসায়ী ইকরাম ফরাজী। দেশ ও মানব সেবার চেষ্ঠায় ব্যবসা শুরু করেন তিনি। শুন্য থেকে শুরু করে হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে তার প্রতিষ্ঠানে। প্রবাসে থেকেও বাংলাদেশকে লালন করেন মনে প্রাণে । বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও শিক্ষার বিস্তারে প্রবাসেও সর্বদা সচেষ্ট থাকেন তিনি।
এই সফল ব্যবসায়ীর জন্ম বাংলাদেশের শরিয়তপুর জেলার জাজিরা থানার সেনেরচর গ্রামে। দুই মেয়ে ও এক ছেলের জনক ইকরাম ফরাজী। তিনি ৬ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে ৫ম। বাবা আবুল হাসেম ফরাজী ছিলেন একজন কৃষক। ইকরাম ফরাজীর শিক্ষা জীবন শুরু হয় তার নিজ গ্রামেই । জাজিরার বি,কে নগর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এস.এস.সি পাস করার পর নারায়নগঞ্জের তোলারাম কলেজ থেকে এইস.এস.সি ও ডিগ্রী পাস করেন।
তিনি বড় হয়ে যে একজন ব্যবসায়ী হবেন তার ভিত রচিত হয় শিশুকালেই। তিনি বলেন, ‘স্কুলে পড়ার সময় ঈদের মধ্যে ব্যবসা করার জন্য ঢাকা থেকে তারাবাতি কিনে নিয়ে যেতাম। গ্রামে ঐ তারাবাতি বিক্রয় করতাম আবার নিজেও বন্ধুদের সাথে তারাবাতি ফুটিয়েছি।’
নারায়নগঞ্জের পাগলায় তাদের কাপড়ের ব্যবসা ছিল। তখন পাগলা থেকে তোলারাম কলেজে পড়ালেখা করতেন ইকরাম ফরাজী। আর পড়ালেখার পাশাপাশি কাপড়ের দোকানে বসতেন। তারপরে ১৯৯৭ সালে তিনি কাজের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান ইতালিতে। আগে থেকেই আরো দুই ভাই ইতালিতে থাকতেন। এরই মধ্যে লেখাপড়া সম্পন্ন হয়ে যায় তার।
ইতালিতে যাওয়ার পর কিভাবে তিনি ব্যবসায়ী হয়ে উঠলেন সে বিষয়ে জানান, ‘ইতালিতে এসে আমার অন্য কোথাও চাকরি করতে হলো না। আমি ভাইদের সহযোগীতায় শুরু করলাম ব্যবসা। আমরা থাকতাম রোমে। রোমে বিভিন্ন সময় মেলা হলে আমরা পাইকারি দোকান থেকে বিভিন্ন আইটেমের জুয়েলারি, খেলনা কিনে আনতাম। তারপর মেলায় নিয়ে সেগুলো বিক্রি করতাম।
এভাবেই শুরু আমার ব্যবসায়ী হয়ে উঠা। আমরা তিন ভাই বসে ভাবলাম আর কি করা যায়। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম মানি চেঞ্জয়ের ব্যবসা করার। তবে এই ব্যবসা করতে হলে কম্পিউটার জানা জরুরি। আমি তো কম্পিউটার জানি না। আর জানব কেমন করে যখন লেখাপড়া করেছি তখন আমাদের মত মধ্যবিত্ত পরিবারে কম্পিউটার বিলাসিতার বস্তু হিসেবে পরিচিত ছিল।
তাছাড়া বিলাসিতা করার মত সামর্থ্যও আমাদের ছিল না। ১৯৯৯ সালে ইতালি থেকে বাংলাদেশে আসি। এসেই ভর্তি হয়ে যায় ৬ মাস মেয়াদি কম্পিউটার কোর্সে। তারপরে ইতালিতে ফিরে এসে শুরু করি মানি চেঞ্জের ব্যবসা। তখন ব্যাংক থেকে ডলার কিনে বিক্রি করতাম। ইতালি কারেন্সি লিরা ব্যাংকে বিক্রি করতাম।
২০০০ সালে কারেন্সি হিসেবে ইউরোর ব্যবহার শুরু হয়। আগে থেকে চিন্তা ছিল কিভাবে বৈধ পথে প্রবাসীরা তাদের কষ্টার্জিত টাকা দেশে পাঠাতে পারবে। তখন পর্য়ন্ত বৈধ ভাকে টাকা পাঠাতে পারত না। মানি ট্রান্সফার ব্যবসা শুরু করার জন্য প্রস্তুতি শুরু করি। প্রথমেই সমস্যাই পড়ি টাকা নিয়ে,ঐ দেশের নিয়ম অনুযায়ী ব্যবসার জন্য ৬লাখের মত ক্যাপিটাল থাকতে হবে।
অত টাকা তখন আমাদের কাছে ছিল না। তবে ইতালিতে ব্যবসা করে আমারা যথেষ্ট সুনাম করতে পেরেছিলাম। আমরা যেখানে কোন বাঙালী সমস্যায় পড়ত সহযোগীতার চেষ্টা করতাম। সব সময় প্রবাসীদের পাশে থাকতাম। সেই সময় আমাদের পরিচিত জনদের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার হিসেবে নিই। এভাবেই শুরু হয় ‘নেক মানি ট্রান্সফার’ কোম্পানীর।
বাংলাদেশের কমিউনিটির সবাই আমাদের মাধ্যমে টাকা পাঠিয়েছে। প্রথম দিকে টাকা পৌঁছতে অনেক সময় লাগত। আমাদের সততা বিশ্বস্ততার প্রতি তাদের বিশ্বাস ছিল। আমরা দেশে বিশ্বস্ততার সঙ্গে তাদের টাকা পৌঁছে দিতে সক্ষম হই।’
তিনি আরো বলেন, ‘এখন পুরো পৃথিবীর ৯০ টি দেশের প্রায় ২লাখ ৫০ হাজার লোকেশন থেকে আমরা রেমিটেন্স রিসিভ করতে পারি। মূলত এখন ইউরোপ জুড়ে আমরা কাজ করছি। আমাদের ইচ্ছা আছে এই বছরের মধ্যে আফ্রিকা ও এশিয়ার কিছু দেশে প্রবাসীদের জন্য কাজ করার।’
আমাদের ব্যবসা শুরুর পরে আমাদের ভাই বোনেরা সবাই এক সাথে ব্যবসার সঙ্গে জড়িত । আমরা যা কিছু করেছি তা এক সাথেই করেছি। আমাদের ব্যবসার মূল বিষয় হলো সততা আর মানুষের সেবা। এই ব্যবসাতে প্রায় এক হাজার তিন শত লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় এক হাজারই বাংলাদেশি।
যখন ইতালি সহ বিভিন্ন দেশ থেকে প্রবাসীরা বৈধভাবে দেশে অর্থ পাঠাতে পারত না তখন আমরা প্রবাসীর কথা চিন্তা করেছি। আমরা ভেবেছি দেশের উন্নয়নের কথা। আজ এই জায়গায় দাড়িয়ে কিছুটা হলেও ভালো লাগে এই ভেবে যে প্রবাসীরা তাদের কষ্টের টাকা বৈধভাবে দেশে পাঠাতে পারছে।’
ফরাজী পরিবার এখানেই থেমে থাকেনি। সেবার মহানব্রত নিয়ে শুরু করা ব্যবসা এখন আরো বেশি প্রসারিত হয়েছে। ইকরাম ফরাজী ভয়েস বাংলাকে আরো বলেন, ‘ইতালি থাকতে আমাদের অনেক সময় বিভিন্ন রোগ শোকে হাসপাতালে যেতে হতো। ইউরোপের হাসপাতালের পরিবেশ, ডাক্তারদের ব্যবহার, নার্সদের সেবা দেখে আমরা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম মানুষের সেবাই দেশে কিছু করা যায় কিনা।
আমার ছোট ভাই আনোয়ার ফরাজী নিজেও একজন ডাক্তার। আমরা ঢাকার বনশ্রীতে ২০১২ সালে ‘ফরাজী হাসপাতাল’ নামে আধুনিক একটি হাসপাতাল গড়ে তুলি। সত্যি বলতে কি ব্যবসা করে লাভ করার উদ্দেশ্য নিয়ে এটা আমরা শুরু করিনি। মানুষের সেবার মানসিকতা নিয়েই মূলত ফরাজী হাসপাতালের যাত্রা শুরু হয়।
অল্প সময়ের মধ্যে সেবার মানে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করে হাসপাতালটি। বর্তমানে প্রায় ২ বিঘা জমির উপর ফরাজী হাসপাতাল পরিচালিত হচ্ছে। এখানে নিয়মিত একশতর উপরে ডাক্তার বসেন। নার্স সহ অন্যান্য স্টাফ আছে ৩৫০ জনের মত। হাজার হাজার মানুষ সেবা পাচ্ছেন এই হাসপাতাল থেকে ।’
ইকরাম ফরাজীর দেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার কথা বলেন, দেশপ্রেমের কথা বলেন। তাই ব্যবসার পাশাপাশি অনেকগুলো সেবা মূলক প্রতিষ্ঠান তিনি গড়ে তুলতে পেরেছেন। নিজ দেশের শিক্ষা সংস্কৃতি নিয়েও তার ভাবনা ছিল। প্রবাসে নতুন প্রজন্ম বাংলাদেশের সংস্কৃতি যেন ভুলে না যায়।
তিনি ইতালির রোমে ব্রিটিশ কারিকুলামে পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন ‘মাদানি ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এন্ড কলেজ’। ১২০ জনের মত শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করে এই প্রতিষ্ঠানটি। এখানে বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ছাড়াও শ্রীলংকান , ইন্ডিয়ান, পাকিস্তানী শিক্ষার্থীরা পড়ছে।’
একজন সফল ব্যবসায়ী ইকরাম ফরাজী ব্যবসার ক্ষেত্রে ক্রমেই সামনের দিকে এগিয়ে চলেছেন। ট্রাভেল্ভ এন্ড কারগো, ফরাজী হাউজিং, ট্রাভেলস্ এন্ড ট্যুরস্, খাবার সহ নানাবিধ ব্যবসায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। ফরাজী পরিবারের সবাই যৌথভাবে এই সব ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। প্রত্যেকটি ব্যবসায় হয়েছে অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা।
তথ্যসূত্র: ভয়েস বাংলা।